নিজস্ব প্রতিনিধি:
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (এসইইউ) অন্তর্দ্বন্দ্বে ছাত্রলীগ কর্মী কাজী হাবিবুর রহমানকে (২৪) কুপিয়ে হত্যা মামলার রায়ে ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতাসহ সব আসামি খালাস পেয়েছেন। কাজী হাবিব সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
আজ বৃহস্পতিবার সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোমনিননেছা এই রায় দেন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনায় থাকা সরকারি কৌঁসুলি নূরে আলম সিরাজী প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রায় ঘোষণার সময় আদালতে মামলার ১১ আসামির মধ্যে ৮ জন উপস্থিত ছিলেন। বাকি তিনজন পলাতক। রায় ঘোষণার সময় বাদীপক্ষ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাউকে আদালতে হাজির হতে দেখা যায়নি।
খালাস পাওয়া ১১ আসামির সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এর মধ্যে মামলার এজাহারে হোসাইন মোহাম্মদ সাগর নামের প্রধান আসামি সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্যপদে আছেন। অন্যরা ছাত্রলীগে তাঁর অনুসারী নেতা–কর্মী হিসেবে পরিচিতি। তাঁরা হলেন আউয়াল আহমদ, আশিক উদ্দিন ওরফে আশিক সিকদার, মইনুল ইসলাম, জুবায়ের আহমদ, নাহিদ হাসান, ইলিয়াস আহমদ, নয়ন রায়, বশির উদ্দিন আহমদ ওরফে তুহিন, শহিদুর রহমান ও আলাউর খান।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রলীগের মিছিলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারে এক পক্ষ কুপিয়ে হত্যা করে কাজী হাবিবুর রহমানকে (২৪)। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী হাবিব ছাত্রলীগের একটি পক্ষের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পরদিন ২০ জানুয়ারি কাজী হাবিবের ভাই কাজী জাকির বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ঘটনাস্থলের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ওই সময় সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পদে থাকা হোসাইন মোহাম্মদ সাগরসহ ১১ জনকে শনাক্ত করে আসামি করা হয়। আসামি শনাক্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১১ জনকে বহিষ্কার করে।
সব আসামি খালাস পাওয়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনায় থাকা সরকারি কৌঁসুলি নূরে আলম সিরাজী প্রথম আলোকে বলেন, মামলার ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে বাদীর সাক্ষ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আদালতকে বলেছেন, কারা হত্যা করেছে, তিনি কিছুই দেখেননি। অভিযুক্তদেরও তিনি চেনেন না। আর নিহত ব্যক্তির মা, আরও এক ভাই এবং এক চাচা সাক্ষ্য দিতে আসেননি। মূলত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী না পাওয়ায় এবং আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের কোনো কিছু না পেয়ে আদালত এই রায় দিয়েছেন। রায়ে সন্তুষ্টি না থাকলে বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারে।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর ‘হাবিব পরিষদ’ ব্যানারে সিলেট নগরে হত্যার বিচার দাবিতে সক্রিয়তা দেখা গিয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মী ও সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রধান আসামিসহ আটজন এ মামলায় জামিনে মুক্ত হন। এর পর থেকে মামলার বিচার চাই দাবিটিও গৌণ হয়ে পড়ে। কাজী হাবিবের পরিবারের সদস্যরাসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তখন নীরব ভূমিকায় দেখা গেছে। এতে আমাদের মনে হয়েছে, আসামিরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ম্যানেজ করেছেন।
মামলাটি তদন্ত করেন সিলেট কোতোয়ালি থানার তৎকালীন তিনজন তদন্ত কর্মকর্তা। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) অখিল চন্দ্র দাস তদন্ত শেষে এজাহারভুক্ত ১১ আসামিকে অভিযুক্ত করে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগ গঠন করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। মামলার বাদীসহ ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আদালত এই রায় দিয়েছেন।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর আট মাস পর অভিযুক্ত সব আসামি খালাস পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ হাবিবের সহপাঠীরা হতভম্ব হয়ে পড়েছেন। অপরদিকে খালাস পাওয়া আসামিরা ছিলেন উল্লসিত। খালাস পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় প্রধান আসামি ছাত্রলীগ নেতা হোসাইন মোহাম্মদ সাগর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা মিছিল করছিলাম—এ চিত্রটি ছিল। এতে প্রমাণ হয় না যে আমরা হত্যায় জড়িত। আমরা আসলে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলাম। যেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু লোক জড়িত ছিলেন। আদালতের রায়ে আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি।’
এ ব্যাপারে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক তারেক উদ্দিন জানান, তাঁরাও বাদীপক্ষকে ম্যানেজ করার বিষয়টি শুনেছেন। কিন্তু এর সত্য–মিথ্যা যাচাই করতে পারেননি। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার বাদীসহ পরিবারের কাউকে তো পাচ্ছি না। অভিযুক্ত সব আসামিই খালাস পেয়েছেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আর কী বলার আছে!’
রায় ঘোষণার সময় আদালত এলাকায় কাজী হাবিবের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। মামলার এজাহারের সঙ্গে দেওয়া বাদী কাজী জাকিরের মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করে ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। কাজী হাবিবের পরিবারের কোনো সদস্যের প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
বিএসডি / আইকে