হেফাজতে ইসলামের নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হকসহ অর্ধশত নেতার বিরুদ্ধে সংগঠনের তহবিল আত্মসাত ও দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংগঠনের শীর্ষ এই নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সংগঠনের তহবিল, বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা এবং ধর্মীয় কাজে আগত বৈদেশিক সহায়তা আত্মসাত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের গোয়েন্দারা যাচাই-বাছাইয়ে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপরই গত ১৭ মে দুদক পরিচালক মো. আকতার হোসেন আজাদের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি টিম গঠিত হয়েছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, হেফাজতের শীর্ষ কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উৎস থেকে অনেকগুলো অভিযোগ জমা পড়ে। সেসব অভিযোগ ও আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কমিশন থেকে সম্প্রতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই মধ্যে একটি অনুসন্ধান টিমও গঠিত হয়েছে। অনুসন্ধানের পর অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৬ সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান টিমের বাকি সদস্যরা হলেন- উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ ও মো. সাইদুজ্জামান এবং উপসহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান।
অনুসন্ধান টিম প্রধান আকতার হোসেন আজাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
তবে এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের তহবিল, বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের অর্থ এবং ধর্মীয় কাজে দেশে আগত বৈদেশিক সহায়তা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির কয়েকজন শীর্ষ নেতা দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন। এমন অভিযোগ সামনে রেখে শুরু হয়েছে দুদকের অনুসন্ধান।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, নূর হুসাইন কাসেমী, মামুনুল হকসহ ৫৪ নেতার ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে। সেখানে তাদের হিসাবে গরমিল পাওয়া যায়। যার একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন ইতোমধ্যে দুদকে পাঠানো হয়েছে। সেটি আমলে নিয়েছে কমিশন।
যে নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছিল- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মুহাম্মদ মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, মহাসচিব সৈয়দ ফয়জুল করীম, আল-হাইয়্যাতুল উলয়াও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি মাহমুদুল হাসান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ প্রমুখ।
এরই মধ্যে হেফাজতে ইসলামের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে ৩১৩ জনকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ডিবি)। এছাড়া সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের ব্যাংক হিসাবে ৬ কোটি টাকার অস্বিত্ব পেয়েছে ডিবি। গ্রেফতার হওয়া হেফাজত নেতা মামুনুল হকের দুটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্তও দুদক আমলে নিয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় যখন সম্পদ করা হয় বা সেই টাকা পাচার, স্থানান্তর, রূপান্তর করা হয়- তখন এটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ।
গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে ঝর্ণা নামে এক নারীকে নিয়ে অবস্থানকালে স্থানীয় জনতার হাতে অবরুদ্ধ হন মামুনুল। পরে তাকে হেফাজত কর্মীরা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। যদিও ঝর্ণাকে তিনি নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করেন।
এর আগে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররম এলাকায় সহিংসতা হয়। পরে ডাকা হরতাল ও বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের তাণ্ডবে ১৭ জন নিহত হয়। এসব ঘটনায় ঢাকায় ১২টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় মোট ৫৩টি মামলা দায়ের হয়। মোট ৬৪টি মামলা তদন্তাধীন আছে। এ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের ১৬ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।