মসজিদই সমস্ত কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্ৰ গৃহ কাবাকে মানুষের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যে কেন্দ্র বানিয়েছেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২৪)
আর মসজিদ হল আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত ও একত্মবাদ এবং তার রসুলের রেসালতের প্রচার-প্রসারের জন্য। আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর মসজিদসমূহ আল্লাহ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট। অতএব তার সঙ্গে আর কাউকে ডেকো না।’ (সুরা জ্বিন, আয়াত : ১৮)
তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ যে ঘরগুলোকে (মসজিদ) উচ্চমর্যাদা দিতে এবং তাতে তার নাম উচ্চারণ করতে আদেশ করেছেন, তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাসবিহ পাঠ করে এমন লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচা-কেনা আল্লাহর স্মরণ, নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায় থেকে গাফেল করতে পারে না। তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টি ওলট-পালট হয়ে যাবে।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩৬-৩৭)
অতএব ঈমানদার হিসেবে আমাদের কর্তব্য, আমরা যে যেখানে থাকি না কেন মসজিদ আবাদ করা। এটি আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি এবং কায়েম করেছে নামাজ, আদায় করেছে জাকাত; আর আল্লাহ্ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করে নি। অতএব, আশা করা যায়, তারা হেদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১৮)
মসজিদ সম্পর্কে কালামুল্লাহর আলোচনার পর এবার আমরা রাসুলুল্লাহর সিরাতের দিকে একটু নজর দিই। হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) যে কাজটির প্রতি সর্বপ্রথম মনোযোগ দিয়েছেন, তা হচ্ছে একটি কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণ ও তা আবাদ করা। মদিনা রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই মসজিদ। মদিনা রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হত মসজিদে নববী থেকে। এ মসজিদেই নবীজী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে তালিম-তরবিয়ত দিতেন, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন, বিধি-বিধান জারি করতেন, বিচারকার্য পরিচালনা, সেনাবাহিনী গঠন, যুদ্ধে সমরদল প্রেরণ, দাওয়াতের জন্য দাঈ প্রেরণ; এমনকি সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়— সকল কার্যক্রম পরিচালনা ও সমস্যার সমাধান এই মসজিদ থেকেই হত। মসজিদে নববীর এসব কার্যক্রম সম্পর্কে জেনে আমাদের বুঝতে বাকি নেই যে— মসজিদে নববী বর্তমান সময়ের মসজিদগুলোর মতো শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত ও জিকির-আজকারের স্থান ছিলো না। এতে কোনো সন্দেহ নেই, নবীজী সা. যেমন আমাদের আদর্শ তেমনিভাবে তাঁর মসজিদও হবে অন্য সকল মসজিদের আদর্শ। এবার আমাদের চিন্তা করতে হবে মসজিদে নববীর আদলে আমাদের মসজিদগুলো কতটুকু পরিচালিত হচ্ছে!?
আদর্শ মসজিদের জন্য প্রয়োজন আদর্শ মুয়াজ্জিন-ইমাম ও খতিব
মসজিদের মুয়াজ্জিনের কয়েকটি গুণ থাকা দরকার: ১. কোরআনে কারিম তাজবিদের সঙ্গে তেলাওয়াত করতে পারা ২. আজান ও নামাজের আহকাম সম্পর্কে জানা থাকা। ৩. উত্তম চরিত্র ও সুন্নতের পাবন্দী হওয়া। ৪. সুন্দর কন্ঠের অধিকারী হওয়া। শেষ গুণটির প্রতি এজন্যই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যে, অনেক সময় দেখা যায় আজানের সুর যদি কর্কশ হয়; মানুষের মন তখন আজানের দিকে ধাবিত হয় না। আর আজানের সুর যদি হয় মিষ্ট ও মধুঝরা, মানুষের মনে তখন এর প্রভাব পড়ে। এজন্যই আমরা দেখি, অনেক অমুসলিম আজানের সুমিষ্ট সুর শুনেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বেলাল (রা.)-এর মতো সুরেলা কন্ঠের অধিকারীকে মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পেছনে অমুসলিদের ইসলামের প্রতি আকর্ষণ করার হেকমত থাকতে পারে!
আর হাদিসের বর্ণনা মতে ইমাম মুসল্লিদের নামাজের দায়িত্ব বহনকারী। ইমামের কয়েকটি গুণ থাকা দরকার। এক. কোরআনে কারিম তাজবিদের সঙ্গে তেলাওয়াত করতে পারা। দুই. কোরআন-সুন্নাহ ও ফিকহ বিষয়ে পারদর্শীতা থাকা। তিন. ‘আলআদালা’ গুণের অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ আকীদা-বিশ্বাস সহিহ থাকা, ইলম-আমল শুদ্ধ থাকা এবং আখলাক-চরিত্র সন্তোষজনক হওয়া, মুত্তাকি-পরহেজগার হওয়া। তার প্রতি যাতে মুসল্লিদের যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত কোনো আপত্তি না থাকে। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তি এমন যাদের সালাত তাদের কানও অতিক্রম করে না (কবুল হয় না)। ১. পলাতক গোলাম যতক্ষণ না সে মালিকের কাছে ফিরে আসে। ২. এমন নারী যে তার স্বামীর অসন্তুষ্টিতে রাত্রি যাপন করে। ৩. এমন ইমাম যাকে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা অপছন্দ করে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬০)
আর যিনি খতিব হবেন, তার মধ্যে উল্লিখিত গুণগুলো আরও উত্তম পর্যায়ে বিদ্যমান থাকা দরকার। কেননা তখন তিনি শুধু মিম্বরের ইমাম নন, মিহরাবের খতিবও। তার দায়িত্ব অনেক বড়। তখন তিনি অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। জাতির শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ও নেতা। একজন খতিবের জাতির কাছে ইসলামকে যুগোপযোগী ভাষায় উপস্থাপন করার পাশাপাশি আধুনিক যুগের প্রচলিত বিভিন্ন মতবাদের যুক্তি খণ্ডন করে ইসলামের সঠিক চিত্র জাতির সামনে তুলে ধরার দক্ষতা থাকা খুবই জরুরি।
একটি আদর্শ মসজিদে কী ধরনের কার্যক্রম চালু থাকা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে নিম্নে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হলো :
এক. নুরানি মাদরাসা : এলাকার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য নুরানি মাদরাসা চালু করা। এতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকতে পারে। এর জন্য মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ হাফিজাহুল্লাহ প্রণীত মক্তবের সিলেবাস, নুরানি বোর্ড প্রণীত সিলেবাস এবং মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রণীত সিলেবাসকে সমন্বয় করে একটি সুন্দর সিলেবাস তৈরি করা যায়। এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে স্কুল শিক্ষার্থী এবং বয়স্কদের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ করে কোরআনের তালিম চালু রাখা দরকার।
দুই. পাঠাগার : মসজিদের একটি অংশে ইসলামি বইয়ের পাঠাগার থাকা দরকার। এতে কোরআন, সুন্নাহ, আকিদা, ফিকহ, সিরাত, তাফসির ও ইসলামি বিভিন্ন বই থাকতে পারে। মসজিদ থেকে বই নিয়ে আবার ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে সবাই পড়ার সুযোগ পাবে। মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে অবগতির জন্য পাঠাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তিন. সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন দারস : মসজিদে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন দারস চালু রাখা যায়। দারসে কোরআন, দারসে হাদিস, দারসে ফিকহ, দারসে আকিদা, দারসে সিরাত প্রভৃতি দারস চালু রাখলে মানুষের ফায়দা হবে। দীনের সহিহ বুঝ আসবে। এর জন্য মসজিদ কর্তৃপক্ষকে যোগ্য আলেম নিয়োগ দেয়া দরকার।
চার. সমাজ সেবামূলক কাজ : মসজিদের যদি একটি সদকা ও জাকাত ফাণ্ড থাকে, তাহলে এর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন ধরনের অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করা যায়। যেমন কেউ চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারছে না, কেউ বিবাহ করতে পারছে না অর্থের অভাবে, কেউ আর্থিক অভাবে একটা রিকশা কিনতে পারছে না— এরকম নানান ক্ষেত্রে ওই ফাণ্ড থেকে সহযোগিতা করা যায়।
পাঁচ. দাওয়াত ও তাবলিগ : আলেমদের পরামর্শক্রমে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ চালু রাখা। অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্যও একটি টিম থাকা দরকার। মাওলানা কালিম সিদ্দিকি হাফিজাহুল্লাহ এর সিস্টেমকে ফলো করে এই কাজে এগিয়ে আসালে ব্যাপক ফায়দা হবে। দাওয়াতি স্টাইলে লেখা কিছু বইও ফ্রি বিতরণ করা যায় অমুসলিমদের মাঝে।
এ ধরনের কার্যক্রম মসজিদে চালু থাকলে জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া পড়বে। মানুষ দীনের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং মসজিদও আবাদ হবে। আমাদের হারানো সেই গৌরবময় অতীত আবার ফিরে পাব ইনশাআল্লাহ।
শিক্ষার্থী, ইমাম মুহাম্মদ বিন সাউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।
বিএসডি /আইপি