নিজস্ব প্রতিবেদক:
রংপুর-নীলফামারী-বাংলাবান্ধা রুটে সোমবার (০৮ নভেম্বর) থেকে নতুন ২০টি বাস চলাচল শুরু হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষরা যাতে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হয়ে সহজে ভারতে যেতে পারেন, এজন্য উদ্যোগ নিয়েছে বাস মালিক সমিতি। পাশাপাশি বিভাগীয় শহর রংপুরে চিকিৎসাসেবা প্রত্যাশী মানুষদের পরিবহন সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখছেন মালিক সমিতির নেতারা। তাদের দাবি, এই বাস সার্ভিসের মাধ্যমে সময় ও ভাড়া সাশ্রয় হবে। একইসঙ্গে যাত্রী হয়রানি ও দুর্ভোগ কমবে।
রংপুর বিভাগে জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। প্রতিদিন বিভাগীয় শহরে নানান প্রয়োজনে বিভিন্ন জেলার মানুষকে আসতে হয়। বিশেষ করে রংপুরের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যবসার প্রয়োজনে রংপুর শহরে মানুষের যাতায়াত আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
তবে রংপুর থেকে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পর্যন্ত চলাচলরত বাসের সংখ্যা কম হওয়াতে এ অঞ্চলের মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এবার সেই দুর্ভোগ কমনোসহ চিকিৎসাসেবা ও পর্যটন শিল্পমুখী মানুষের যাতায়াত সুবিধা বাড়ানোর যৌথ উদ্যোগ ‘রংপুর-বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’ বাস সার্ভিস। ৩০ মিনিট পরপর ছেড়ে যাওয়া এসব বাস রংপুর থেকে নীলফামারী হয়ে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা পর্যন্ত চলাচল করবে।
সোমবার (০১ নভেম্বর) নীলফামারীতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে নতুন বাস সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বৈঠকে রংপুর, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার বাস মালিক সমিতির নেতারা অংশ নেন। তাদের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। কোনো কারণে যাতে নতুন এই পরিবহন সুবিধা থমকে না যায়, সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান যাত্রীদের।
রংপুর নগরীর ভ্রমণপিপাসু যুবক কামরুল হাসান টিটু ঢাকা পোস্টকে বলেন, রংপুর বিভাগের মানুষের জন্য এটি ভালো খবর। রংপুর-বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস বাস সার্ভিস চালু হলে আমরা মালিক সমিতির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। কারণ এখন বাসে রংপুর থেকে পঞ্চগড় যেতে ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস চালু হলে ত্রিশ টাকা সাশ্রয় হবে। তাছাড়া পর্যটনপ্রেমীদের জন্য এ ধরনের বাস সার্ভিস বেশ আনন্দের। শুধু রংপুর, নীলফামারী বা পঞ্চগড় জেলা নয়, পুরো বিভাগের মানুষ উপকৃত হবে।
মেডিকেল মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন মুন্না ও আবিদ নামে দুই তরুণ। তারা দুজন রোগী দেখতে পঞ্চগড় থেকে রংপুরে এসেছিলেন। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে পথে পথে ভোগান্তি আর যাত্রী হয়রানির কথা জানান তারা। তাদের কাছে ‘রংপুর-বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’ বাস চালুর ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মুন্না বলেন, এই বাস সার্ভিস চালু হলে আমরা অনেক বিড়ম্বনা থেকে বেঁচে যাব। এখন রংপুর আসতে বেশি ভাড়া গুনতে হয়। সঙ্গে দুর্ভোগও আছে। শুনেছি রংপুর থেকে নীলফামারী হয়ে পঞ্চগড় রুটে নতুন বাস চালু হচ্ছে। এটা হলে আমাদের যাতায়াত সুবিধা বাড়বে। কষ্টও লাঘব হবে।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভোজনপুর বাজার এলাকার ব্যবসায়ী মানিক হোসেনকে প্রায়ই ব্যবসায়িক কাজে রংপুর আসতে হয়। রংপুর-বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস বাস চালুর সংবাদে তিনিও খুশি। ঢাকা পোস্টের পঞ্চগড় জেলা প্রতিনিধি রনি মিয়াজীর সরঙ্গে আলাপকালে এই ব্যবসায়ী জানান, তার মতো অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও চিকিৎসা এবং চাকরিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে রংপুর যাতায়াত করেন। প্রায় সময়ই বাস পাওয়া যায় না। বাসের অপেক্ষায় ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। আবার বাসে উঠলে কখনো কখনো দাঁড়িয়ে যেতে হয়। গুরুতরর অসুস্থ রোগীদের নিয়ে বাসে যাতায়াত করাটা তাদের জন্য বেশি কষ্টকর। যদি নতুন বাস সার্ভিস চালু হয়, তাহলে পঞ্চগড়ের মানুষ অনেক বেশি উপকৃত হবেন। পাশাপাশি সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে।
একই উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের নিজবাড়ী গ্রামের হাসান আলী। তিনি প্রায়ই তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রংপুরে যাতায়াত করেন। পাশাপাশি বিভাগীয় শহর রংপুর থেকে ব্যবসার জন্য জিনিসপত্রও কিনে থাকেন। পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান হাসান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দিন ধরেই আমরা এ রকম বাস সার্ভিসের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন শুনে ভালো লাগছে পঞ্চগড় থেকে রংপুরে প্রতিদিন আধ ঘণ্টা পর পর মেইল বাস ছেড়ে যাবে। এতে আমাদের কষ্ট কমে আসবে। সময় ও ভাড়া সাশ্রয় হবে।
ঢাকা পোস্টের নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি মাহমুদ আল হাসান রাফিন কথা বলেছেন সেখানকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। স্থানীয় টুপামারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম মানিক জানান, তিনি প্রতি বছর সুযোগ পেলে শীতের মৌসুমে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ও বাংলাবান্ধা যান। নীলফামারী থেকে অনেকেই চিকিৎসার জন্য বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট হয়ে ভারতে যান। এজন্য নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে দশমাইল ও ঠাকুরগাঁও হয়ে বাংলাবান্ধা যেতে হতো। নতুন বাস সার্ভিস চালু হলে তারা নীলফামারী থেকে সরাসরি বাংলাবান্ধা যেতে পারবেন।
সমাজ উন্নয়নকর্মী আব্দুল আলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রংপুর থেকে নীলফামারী হয়ে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা পর্যন্ত নতুন এক্সপ্রেস বাস সার্ভিস চালু হলে আমাদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমে আসবে। বিশেষ করে নীলফামারী থেকে বাংলাবান্ধা যেতে তিনটি টার্মিনাল বা বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে যেতে হয়। এতে সময় অপচয়ের সঙ্গে যাত্রী সাধারণ বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। এখন এই দুর্ভোগ লাঘব হবে। পাশাপাশি পরিবহন সুবিধা সহজ হলে মানুষের যাতায়াতও বাড়বে।
নতুন এই বাস সার্ভিস প্রসঙ্গে পঞ্চগড় জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি মতিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, আগামী ৮ নভেম্বর থেকে রংপুর-বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস নামে ২০টি বাস চলাচল করবে। এসব বাস পঞ্চগড় থেকে নীলফামারী হয়ে রংপুরে যাবে। প্রতিদিন পঞ্চগড় থেকে সকাল সোয়া ৭টা থেকে শুরু করে ৩০ মিনিট পরপর বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত চলাচল করবে। অপরদিকে রংপুরে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ৪০ মিনিট পর পর পঞ্চগড়ের উদ্দেশে বাসগুলো ছেড়ে আসবে।
এই রুট বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তিন জেলার মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে স্বল্প ভাড়ায় তাদের গন্তব্যে পৌঁছাবে। বিশেষ করে পঞ্চগড়ের মানুষ বিভাগীয় শহর রংপুরে গিয়ে তাদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও অফিস-আদালতসহ অন্যান্য কাজের প্রয়োজনে দ্রুত যাতায়াত করতে পারবেন। বিআরটিসিসহ অন্যান্য জেলায় যে বাসগুলো প্রধান ও মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে, তার তুলনায় এসব গাড়ির মান অনেক ভালো ও আরামদায়ক হবে। যাত্রীরা নতুন বাস সার্ভিসে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। অন্য রুটে চলাচলরত গাড়ির তুলনায় নতুন বাস সার্ভিসে পঞ্চগড় থেকে রংপুরে পৌঁছাতে যাত্রীদের অন্তত এক ঘণ্টা কম লাগবে।
অন্যদিকে রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির সহসভাপতি আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের যাতায়াতে দুর্ভোগ লাঘব ও গরিব মানুষের কষ্ট লাঘবে দীর্ঘদিন ধরে আমরা চেষ্টা করছিলাম রংপুর-বাংলাবান্ধা রুটে বাস সার্ভিস চালু করব। অবশেষে তা ৮ নভেম্বর থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। পঞ্চগড় ও নীলফামারী থেকে ছয়টি করে এবং রংপুরের আটটিসহ সর্বমোট ২০টি বাস চলাচল করবে। রংপুর থেকে ১২৫ কিলোমিটারের পথ বাংলাবান্ধা। এই রুটে রংপুর থেকে জনপ্রতি যাত্রীকে ১৭০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। সাড়ে তিন ঘণ্টায় রংপুর থেকে নীলফামারী হয়ে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছাবে এসব গাড়ি।
যেভাবে ‘রংপুর-বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’ মেইল বাস চেনা যাবে
রংপুর-নীলফামারী-পঞ্চগড় রুটে চলাচলরত এসব গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা থাকবে। পতাকার ওপরে সবুজ এবং নিচে হবে লাল রঙ। রংপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৩০-৪০ মিনিট পর পর রংপুর-বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস মেইল বাস ছেড়ে যাবে।
এসব বাসের স্টপেজ হবে রংপুর থেকে পাগলাপীর, তারাগঞ্জ হয়ে কিশোরগঞ্জ, টেঙ্গনমারী, নীলফামারী, গাছবাড়ী, নীলসাগর সড়কে, ভবানীগঞ্জ, সোনাহাট, দেবীগঞ্জ, সাখওয়া, বোদা, পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া ও বাংলাবান্ধা। দীর্ঘ ১২৫ কিলোমিটারের এ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা। রংপুর থেকে পঞ্চগড় যেতে ভাড়া ১৭০ টাকা এবং নীলফামারী থেকে পঞ্চগড়ে ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিএসডি /আইপি