নিজস্ব প্রতিনিধি:
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তাই রাতের আঁধারে নিয়মিত চলে অস্ত্র হাতে মহড়া। আর এসব অস্ত্রের জোগান দিতে ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় আগে মহেশখালীর কারিগররা কাজ করলেও এখন প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা কারিগররাই অস্ত্র তৈরি করছে। এ রকম বেশ কয়েকটি কারখানার তথ্য রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
সোমবার (৮ নভেম্বর) ভোররাতে এমনই একটি কারখানা থেকে ১০টি অস্ত্র এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ তিন রোহিঙ্গা কারিগরকে আটক করেছে র্যাব। এছাড়াও গত বছরের ৫ অক্টোবর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার খোঁজ পায় তারা। সেখান থেকে দুই অস্ত্র তৈরির কারিগরকে আটকও করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে তিনটি দেশি অস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলি ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আটক দুজন কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বাসিন্দা আনোয়ার (৫০) ও এখলাস (৩২)।
তবে সোমবার সন্ধান পাওয়া অস্ত্রের কারখানার কারিগররা রোহিঙ্গা নাগরিক। তারা হলেন- কুতুপালং ক্যাম্প সি-১ জি ব্লকের মৃত আজিজুর রহমানের ছেলে বাইতুল্লাহ (১৯), তার ভাই হাবিব উল্লাহ (৩২) ও একই ক্যাম্পের জি ব্লকের জাহিদ হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ হাছুন (২৪)।
এদিকে রোহিঙ্গারা নিজেরাই অস্ত্র তৈরি করায় বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনকে। কারণ নিজেরা অস্ত্র তৈরি করতে পারলে মজুদও বেশি করতে পারবে।
আটক তিন রোহিঙ্গা
র্যাব বলছে, উখিয়ার কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের লম্বাশিয়া শিবিরের আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে এবং ২২ অক্টোবর বালুখালীর দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া মাদরাসায় ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় ক্যাম্প জুড়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে নামে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ। ইতোমধ্যে তারা উখিয়ার কুতুপালং ও পালংখালী ক্যাম্পের গহীন পাহাড়ে আরও বেশ কয়েকটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর সিপিএসসি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান বলেন, মূলত আগের কারখানায় মিলেছিল মহেশখালী থেকে ভাড়া করে আনা কারিগর। কিন্তু নতুন যে কারখানার সন্ধান মিলেছে সেখানে তিনজন রোহিঙ্গা রয়েছে। যারা মহেশখালীর কারিগরদের থেকে আরও প্রশিক্ষিত। যার কারণে নতুন করে পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে আমাদের।
র্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, সীমান্ত ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা থেকে গত চার বছরে (২০১৯ থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) প্রায় ১৯০টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গোলাবারুদ পাওয়া গেছে ছয় শতাধিক।
র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়েরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র এই কারখানা তৈরি করে অস্ত্র বানিয়ে আসছিল। এখান থেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছিল। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে কারখানাটি শনাক্ত করা হয়। তারপর আজ ভোরে চার ঘণ্টারও বেশি সময় গোলাগুলির পর কারখানাটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ৫টি পিস্তল, ৫টি বন্দুক ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম।
উদ্ধারকৃত অস্ত্র
তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা ঠেকাতে কাজ করে যাচ্ছেন র্যাব সদস্যরা। এ রকম আরও কয়েকটি কারখানার তথ্য ইতোমধ্যে আমাদের কাছে রয়েছে। সেগুলোও নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ ও উখিয়া থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ১৭টি। ২০২০ সালে হয়েছে ২৭টি। চলতি বছরের ১০ মাসে অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ২৫টি। এ সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৭টি দেশি পিস্তল, ৫৫টি এলজি, ৪টি বিদেশি পিস্তল, ৪০টি একনলা বন্দুক, ৩০টি দেশি বন্দুক, ৭টি পাইপগানসহ বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) কামরান হোসেন জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যার পর ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৩৯টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী সবাইকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অস্ত্রধারীদের ধরতে অভিযানও চলছে। কোনোভাবে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা হবে না।
বিএসডি / আইকে