নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় উপকূলীয় এলাকার অর্ধলাখ মানুষ ও লক্ষাধিক পশু ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। পরদিন দেখা যায় মানুষ ও গবাদি পশুর লাশ আর লাশ।
সে থেকে ভয়াল ঘটনার পর উপকূলের মানুষের জানমালের রক্ষায় ১৯৭২ সালে আশ্রয়ণ কেন্দ্রের পাশাপাশি নির্মাণ মাটির কিল্লা। যা পরবর্তীতে ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিত হয়।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিবি) ও রেড ক্রিসেন্ট সূত্রমতে, জেলার হাতিয়া ও সুবর্ণচর উপজেলার উপকূলে ৩৩টি কিল্লা নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব কিল্লা পরিদর্শনও করেন। তখন তিনি কিল্লাগুলো দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেড ক্রিসেন্টকে দায়িত্ব প্রদান করেন।
এসব কিল্লার কারণে ১৯৮৫ ও ১৯৯১ এর ভয়াবহ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পেয়েছিল এ উপকূলের মানুষ। কিন্তু বর্তমানে এ কিল্লাগুলো বেদখল হয়ে গেছে। ৩৩টি কিল্লার মধ্যে হাতিয়া উপজেলার ৩টি কিল্লা বিভিন্ন সময়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অবশিষ্ট ৩০টি কিল্লার মধ্যে সুবর্ণচরে ৩টিতে মুজিব কিল্লা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি ২৭টি কিল্লার প্রায় সব কয়টিই বর্তমানে বেদখলে।
স্থানীয়রা বলছেন, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি জেলা ইউনিট এসব কিল্লা দেখভাল করার কথা থাকলেও স্থানীয় দখলদার, প্রভাবশালী ও কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের লোকজনের মধ্যে তা লিজ দিয়ে দেয়।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি নোয়াখালী জেলা ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫-৫০ ফুট উচ্চতার হাতিয়ায় ১৮টি এবং সুবর্ণচরে ১৫টি কিল্লা নির্মাণ করা হয়। প্রত্যেকটি কিল্লার অনুকূলে ৫ একর জমি বরাদ্দ হয়। কিল্লা নির্মাণের জন্য কাটা হয় ২টি করে পুকুর। নির্মাণ শেষ হলে এসব কিল্লাগুলোর তত্ত্বাবধান, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন পশু-পাখির আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহারের জন্য রেড ক্রিসেন্টকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, সুবর্ণচরের মোহাম্মদপুর ও চরজব্বর ইউনিয়নে নির্মিত কিল্লাটিতে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছের ঘের করা হয়েছে। স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী কিল্লাগুলো দখল করে রেখেছে। কেটে ফেলা হয়েছে অসংখ্য গাছ। একই অবস্থা চর আমান উল্যাহর কাটাবুনিয়া গ্রামের কিল্লাটিরও। এটি কেটে বাণিজ্যিকভাবে মুরগি, মাছ ও গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। সীমানা দেয়াল তোলা হয়েছে কিল্লার তিন পাশে।
উন্নয়ন সংস্থা সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী প্রধান রফিক উল্যাহ সুমন জানান, দখলের কারণে বর্তমানে কিল্লাগুলো তার প্রকৃত আকার হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে কিল্লাগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
চর তোরাব আলী গ্রামের বাসিন্দা দিদারুল আলম জানান, এই এলাকার কিল্লাটি রেড ক্রিসেন্টের দায়িত্বে। গত ৩-৪ বছর আগে তারা কিল্লাটি লিজ দিয়েছে, কিন্তু কাকে দিয়েছে তা আমার জানা নেই। লিজ নেওয়া লোকজন কিল্লা থেকে প্রায় দুই শতাধিক গাছ কেটে নিয়ে গেছে।
মোহাম্মদপুর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি সিপিবি ইউনিয়ন টিম লিডার মো. নূর নবী জানান, সুবর্ণচরের প্রায় সবগুলোই দখলে চলে গেছে। নিয়ম না থাকলেও সোসাইটির জেলা ইউনিটের কর্মকর্তাদের নিজস্ব লোকজনকে লিজ দেওয়া হয়। কোন কিল্লার গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে, কোথাও সমতলে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে নির্মিত হয়েছে গরু, মুরগির খামার ও বসতি। দখলের বিষয়টি সোসাইটির বাৎসরিক সাধারণ সভায় জেলা ইউনিটের কর্মকর্তাদের একাধিকবার জানানো হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোন ব্যবস্থা নেননি কর্তৃপক্ষ ।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি – সিপিবি সুবর্ণচর উপজেলার লিডার আবদুর রব জানান, ৭২-৭৩ অর্থবছরে এ কিল্লাগুলো নির্মাণ করা হয়। কিল্লাগুলো কিছু আছে সরকারি খাস জমির ওপর, কিছু স্থানীয় মালিকরা তখন দান করেছিলো এগুলো এখন তাদের উত্তরাধিরাই ভোগ করে।
চরজব্বর ইউনিয়নের কিল্লা দখলকারী আবুল কাশেম বলেন, মালিকানা জায়গা আমি ক্রয় করে নিয়েছি। এটা মুজিব কিল্লা কি-না তা আমার জানা নেই।
জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উপ-পরিচালক আবদুল করিম কিল্লার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সাধারণ সম্পাদক বিস্তারিত বলতে পারবেন।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি নোয়াখালী ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীন বলেন, কিল্লাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশই বেদখল হয়ে গেছে। যদিও অর্ধেকের বেশিই কাগজপত্র আমাদের কাছে থাকলেও প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা করছে না। এই কিল্লাগুলো দুর্যোগের সময় স্থানীয়দের জানমালের নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো।
বিএসডি/এসএইচ