ঈদুল ফিতরের পর থেকে দেশে সংক্রমণ বেড়েছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। ইতোমধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে সীমান্তবর্তী অন্য জেলাগুলোতে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এরইমধ্যে বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের রোগী পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হচ্ছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
তবে শঙ্কা বেড়েছে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন দেওয়াতে। সেখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে ২০ জনের শরীরে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, সীমান্তবর্তী অন্য জেলাগুলাতেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আর কোনও জেলায় লকডাউন দেওয়া হবে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। তবে এতে দ্বিধার সুযোগ নেই জানিয়ে নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘যেখানে পরিস্থিতি যেমন হবে, সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য, সরকার যেকোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বিশেষ নজর রাখছে অধিদফতর।’
সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁতেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মনজুর মোর্শেদ। তিনি বলেন, বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শতকরা প্রায় ৫৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। শুক্রবার (২৮ মে) ৪৫ জনের নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করে ২৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ন্যূনতম ২২টি জেলায় সংক্রমণের হার বেড়েছে। এর মধ্যে ১৫টিই সীমান্তবর্তী জেলা।
অ্যালার্মিং জেলা
এদিকে, কোন জেলার সংক্রমণকে অ্যালার্মিং বিবেচনা করা যায় প্রশ্নে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনাবাংলা বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ এবং যশোরে গত সপ্তাহে সংক্রমণ খুব বেশি ছিল।
এগুলো সব সীমান্তবর্তী জানিয়ে তিনি বলেন প্রতিটি জেলাতেই সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের বেশি।
সম্প্রতি যেসব জেলায় রোগী বাড়ছে সেখানে কন্টাক্ট ট্রেসিং করে আইইডিসিআর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, প্রতি সপ্তাহেই রোগী বিশ্লেষণ করা হয়। আগামী সপ্তাহে যখন দেশজুড়ে পর্যালোচনা করা হবে তখন হয়তো আরও পরিবর্তন আসতে পারে।
তবে যশোর জেলার সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, তার জেলায় এপ্রিলের চেয়ে মে’তে সংক্রমণ কমেছে। এপ্রিলে সংক্রমণের হার ছিল ২৫ শতাংশের মতো। মে’তে ১৫-২০ শতাংশে নেমেছে।
‘এখন পর্যন্ত যশোর নিয়ে আমি সেভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নই’ জানিয়ে ডা. আবু শাহীন বলেন, তবে পর্যবেক্ষণে রয়েছে। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ না যাওয়া পর্যন্ত আগাম কিছু বলা যাচ্ছে। আপাতত যশোরকে অ্যালার্মিং বলে ভাবছেন না তিনি।
সংক্রমণের হার বেড়েছে বলে জানান কুষ্টিয়া জেলার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম। আগে প্রতিদিন সংক্রমণে হার ছিল ১১ শতাংশ পর্যন্ত, কিন্তু চলতি সপ্তাহে সেটা ১৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।
ডা. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে ভর্তিও বেড়েছে। আজ (২৮ মে) ভর্তি আছেন ৩১ জন, যা আগে দুই থেকে তিনজন ছিল। কিন্তু আজ একদিনেই ভর্তি হয়েছেন ১০ জন। এর আগে রোগী কম থাকলেও তাদের অবস্থা খারাপ ছিল। তবে এখন রোগী বাড়লেও খারাপ অবস্থা হয়েছে এমন রোগী কম।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে গত ১৬ মে থেকে ২২ মে পর্যন্ত এক সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের চেয়ে সংক্রমণ বেড়েছে। তার আগের সপ্তাহে (৯ মে থেকে ১৫ মে) রোগী শনাক্ত হয় সাত হাজার ৬৬৯ জন আর পরের সপ্তাহে রোগী শনাক্ত হয় সাত হাজার ৯৩০ জন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খুলনা বিভাগে। যা শতকরা ১১৭ শতাংশ। এর আগের সপ্তাহে এই বিভাগে শনাক্ত ছিলেন ৩৭৬। যা পরের সপ্তাহে দাঁড়ায় ৮১৬ জনে।
রংপুর বিভাগে ৯৯ দশমিক তিন শতাংশ শনাক্ত বেড়েছে গত সপ্তাহে। গত সপ্তাহে ছিল ২৭১ জন। আগের সপ্তাহে শনাক্ত ছিল ১৩৬ জন।
এ ছাড়া ঢাকা বিভাগে তার আগের সপ্তাহের চেয়ে শনাক্ত বেড়েছে ২২ দশমিক এক শতাংশ। প্রতি ১০০ জনে এই বিভাগে করোনাতে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন। তবে এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম শনাক্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. শাহরিয়ার কবির বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে এখনও ১০-এর নিচে নামেনি সংক্রমণের হার। তবে সম্প্রতি যে সংক্রমণের হার বাড়ছে তার কিছুটা প্রভাব পড়েছে কেবল কক্সবাজারে। সেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ লাখ মানুষ। সংক্রমণের হার বেড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ হয়েছে।
সংক্রমণের হার বাড়ার কারণে সেখানে উখিয়া এবং টেকনাফে লকডাউন দেওয়া হয়েছে এক সপ্তাহের জন্য। জানালেন ডা. শাহরিয়ার কবির।
এদিকে, পরিস্থিতি বিবেচনায় সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও খুলনাতেও লকডাউন দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম।
তিনি বলেন, প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ সংক্রমণ হার বাড়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। আশেপাশের জেলা যেমন সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও খুলনাতেও সংক্রমণের হার বাড়ছে। তবে এখনও সেখানে সংক্রমণের হার ২০ এর নিচে। আমরা চিন্তা করছি, সেখানে লকডাউন দেওয়া হবে কিনা।
অধ্যাপক খুরশিদ আলম বলেন, ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে এমন আটজন রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের। তাদের প্রত্যেকে ভারতে গিয়েছিলেন। তবে এখনও তারা সবাই ভালো আছেন।
সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে মন্তব্য করে আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সংক্রমণের হার এক অর্থে বাড়তির দিকে।
বর্ডার এলাকা খোলা থাকা এবং ঈদের আগে ও পরের যাতায়াতকেও সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন এই মহামারি বিশেষজ্ঞ।