জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
রাজধানীর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ার (হাফ পাস) দাবিতে। এর মধ্যে ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজছাত্রের মৃত্যুর ঘটনার পর তা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রূপ নেয়। সোমবার রাতে রামপুরায় বাসচাপায় মাঈনুদ্দিন ইসলাম নামের আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু তাতিয়ে দিয়েছে কোমলমতিদের। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে রামপুরার রাস্তাটি বন্ধ করে রাখে তারা। বিক্ষোভ করে দিনভর।
আন্দোলনের ২০তম দিনে গতকাল মতিঝিল, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও ও বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ের সামনেও অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। এর আগের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো শিক্ষার্থীরা যানবাহনের লাইসেন্সও যাচাই করেছে। দিন শেষে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ৯ দফার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
শিক্ষার্থীদের অবস্থান ও বিক্ষোভের কারণে ঢাকার প্রধান সড়কগুলো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। যানজট ও পরিবহন সংকটে চরম দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। রাস্তায় বাস কমে যাওয়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশাসহ ছোট যানবাহনে বেশি ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের।
তিন বছর আগে রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল শিক্ষার্থীরা। বর্তমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা হাফ পাসসহ সড়কের নিরাপত্তায় ৯ দফা দাবি তুলে ধরেছে।
গতকাল সকাল ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় প্রগতি সরণি বন্ধ করে বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেছে ইম্পেরিয়াল কলেজ, ঢাকা ন্যাশনাল কলেজ, একরামুননেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শুরুতে সম্পূর্ণ রাস্তা অবরোধ করলেও পরে শুধু বাস আটকে রেখে বাকি সব পরিবহন (পণ্যবাহী এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ইত্যাদি) ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। রামপুরা ব্রিজের ওপর থেকে আবুল হোটেলের সামনে অবস্থান নেয় কয়েক শ শিক্ষার্থী। পাশপাশের সড়ক তীব্র যানজটের কবলে পড়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা সমস্বরে চিৎকার করে বলছে, ‘নিরাপদ সড়ক চাই, জীবনের নিরাপত্তা চাই। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ এ সময় শিক্ষার্থীদের হাতে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। কয়েকটিতে লেখা ছিল, ‘আমার বাবা কাঁদছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে’, ‘ছাত্রজনতা ঐক্য গড়ো, নিরাপদ সড়কের দাবি তোলো’, ‘অ্যাম আই নেক্সট’, ‘রাতের আঁধারে শিক্ষার্থী মরে, প্রশাসন ঘুম পাড়ে’।
এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের একটি দল সড়কের এক পাশের লেন উন্মুক্ত করে দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দেয়। তদারকিও করে নিজেরা। এতে লেন মেনে চলতে গিয়ে গতি শ্লথ হয় যানবাহনের। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল। শিক্ষার্থীদের একটি দল চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনের কাগজপত্র যাচাই করে ছাড়ছিল।
বিকেল ৩টার দিকে আজ বুধবার সকাল ১১টায় আবার রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়ে শিক্ষার্থীরা। এ সময় খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া ঘোষণা দেয়, ‘বুধবার তাদের বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, রামপুরা আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। তাদেরকে বুঝিয়ে সড়কের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে পুলিশ।
২৭ নম্বরে মিরপুর সড়কও অবরুদ্ধ
সকাল ১১টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে মিছিল নিয়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ধানমণ্ডি-২৭-এর আন্দোলনে ঢাকা কলেজ, আডিয়াল কমার্স কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ, সেন্ট জোসেফ, বিএএফ শাহীনের মোহাম্মদপুর পাবলিক স্কুল এবং ধানমণ্ডি গভ. বয়েস স্কুলের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে। এতে মিরপুর রোডে শত শত যানবাহন আটকে যায়। বেশির ভাগ বাস থেকে যাত্রীরা নেমে যাওয়ায় বাসগুলো ফাঁকা দাঁড়িয়ে ছিল। তবে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট কারগুলোর কাগজপত্র দেখে ছেড়ে দেয়।
সকাল ১১টার পর মোহাম্মদপুরের আল্লাহ করিম মসজিদের সামনের মোড়ে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীদের একটি দল। এতে মোহাম্মদপুর থেকে বিভিন্ন রুটে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) দুলাল খান জানান, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বিভিন্ন দাবিতে অবস্থান নিয়েছে। পরে তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়।
মতিঝিলে বাস ভাঙচুর
গতকালও নটর ডেম কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। শাপলা চত্বর এলাকায় বিক্ষোভ করেছে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় দুটি বাস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
মতিঝিল থানার ডিউটি অফিসার জানান, দুপুর সোয়া ২টার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল শাপলা চত্বর এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় বাস ভাঙচুর করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
পুলিশ সদস্যের জরিমানা গতকাল দুপুর ২টার দিকে রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে মোটরসাইকেলের লাইসেন্স না থাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন এক পুলিশ সদস্য। পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ওই পুলিশ সদস্যকে ২৫০ টাকা জরিমানা করা হয়। পুলিশের একটি নাম্বার প্লেটবিহীন মোটরসাইকেল আটক করে শিক্ষার্থীরা। পরে সেটিকে রামপুরা পুলিশ বক্সের ভেতরে নিয়ে যায় তারা। পুলিশের খিলগাঁও জোনের এডিসি নুরুল আমীন শিক্ষার্থীদের শান্ত করেন।
দুর্ভোগ শহরজুড়ে
গতকাল কার্যত সারা শহরেই যানজট লেগে ছিল। অনেকে বাস ছেড়ে হেঁটে গন্তব্যে গেছে। কেউ কেউ যানজট পার হয়ে সিএনজি-অটোরিকশা এবং রিকশায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে গন্তব্যস্থলে গেছে। অনেককেই যেদিক থেকে আসছিল সেদিকেই গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু যেদিকেই গেছে, কিছুদূর গিয়ে যানজটে পড়েছে।
দুপুরে নতুনবাজারে একটি সিএনজিকে ধাক্কা দেওয়ায় একটি বিআরটিসি বাসে ভাঙচুর করে উত্তেজিত কয়েকজন যাত্রী।
ধানমণ্ডি-৩২-এ যাওয়ার জন্য মিরপুর-১ থেকে বাসে উঠেছেন আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেট্রো বাসে কলেজগেট পর্যন্ত আসার পর রাস্তায় বেশ জ্যাম ছিল। পরে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। ধানমণ্ডি-২৭-এ আসার পর দেখলাম, রাস্তা আটকে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছে। আমার মতো অনেকে হেঁটে গন্তব্যে যান।’
রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ৫৭ বছর বয়সী আয়েশা খাতুন জানান, মালিবাগ রেলগেট থেকে রামপুরা পর্যন্ত হেঁটে এসেছেন। যাবেন উত্তর বাড্ডায় বড় বোনের বাসায়। তিনি বলেন, ‘আমার বড় বোন হার্ট অ্যাটাক করেছে। তাকে দেখতে যাব বলে বের হয়েছি। কিন্তু মালিবাগ থেকেই সব গাড়ি আটকে আছে। কোনো গাড়ি চলছে না। কিচ্ছু পাচ্ছি না।’
রামগঞ্জে মানববন্ধন
আমাদের লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, নিরাপদ সড়কের দাবিতে গতকাল দুপুরে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনে মানববন্ধন করছে। এ সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রামগঞ্জের সন্তান ঢাকার নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি জানায় তারা।