জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
দেশের শীর্ষ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানে যাবতীয় নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, এফডিআর করার নামে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট, স্ত্রী স্বজনদের চাকরি দেওয়ার নামে অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে গাড়ি ক্রয় ও অবৈধভাবে বিলাসবহুল বাড়ির ব্যবহার এবং বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ সুবিধা গ্রহণের আড়ালে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ওই নথিপত্র তলব করা হয়েছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে যাবতীয় অনুলিপি চাওয়া হয়েছে। শনিবার (১১ ডিসেম্বর) দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর বরাবর পাঠানো চিঠিতে চাহিদা রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে-
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ২০১০ থেকে আজ পর্যন্ত জমি ক্রয় সংক্রান্ত চাহিদাপত্র, অনুমোদিত বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনা প্রাক্কলন, রেজুলেশন, নোটশিট, প্রশাসনিক অনুমোদন, রেজিস্ট্রেশন দলিল, উল্লেখিত জমি ক্রয়ের বিপরীতে বরাদ্দ করা ব্যাংক চেক ও পে-অর্ডারের ছায়ালিপি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ২০১২ থেকে এখন পর্যন্ত গাড়ি বা মোটরযান ক্রয় সংক্রান্ত চাহিদাপত্র, অনুমোদিত বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনা প্রাক্কলন, রেজুলেশন, নোটশিট, প্রশাসনিক অনুমোদন, উল্লেখিত গাড়ি ও মোটরযান ক্রয়ের বিপরীতে বরাদ্দ করা ব্যাংক চেক, পে-অর্ডারের কপি, রেজিস্ট্রেশন, শুল্কায়ন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের ছায়ালিপি।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অনুমোদিত ব্যাংক হিসাবের তালিকাসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালার ছায়ালিপি, ক্রয় নীতিমালা ছায়ালিপি এবং সিন্ডিকেট এবং বিভিন্ন কমিটির সিটিং অ্যালাউন্স দেওয়ার নীতিমালার নথিপত্র এবং ২০১৪ থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এবং বিভিন্ন কমিটির সিটিং অ্যালাউন্স বরাদ্দ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের ছায়ালিপি।
চাহিদা করা নথিপত্র অতি জরুরি ভিত্তিতে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ২৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আজিম উদ্দিন আহমেদ এবং এম এ কাসেম সিন্ডিকেটের দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও তদারকী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়।
কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের তদারকিতে কর্মকর্তা ও উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়সালকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনুসন্ধান ও তদারকি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জানিয়েছিল আইন ও মানবাধিকার ফাউন্ডেশন। ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ‘আজিম উদ্দিন ও এম এ কাশেম সিন্ডিকেট’ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি লুটেপুটে খাচ্ছেন। মূলত এই সিন্ডিকেটের কারণে নর্থ সাউথে অনিয়ম পরিণত হয়েছে নিয়মে। কম মূল্যের জমি বেশি দামে ক্রয়, ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নেওয়া, শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে অবৈধভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয়, লাখ টাকা করে সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, অনলাইনে মিটিং করেও সমপরিমাণ অ্যালাউন্স গ্রহণ, নিয়ম ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের ৪০৮ কোটি টাকা নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংকে এফডিআর, মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে কয়েকগুণ শিক্ষার্থী ভর্তি ইত্যাদি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ারও সরকারের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ জমা পড়েছে।
এসব অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনও হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ড. সুফী সাগর সামস নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের কবল থেকে রক্ষার দাবি জানান।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর জীবন। এত বেশি অনিয়মের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মানও ক্রমেই নিম্নমুখী।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আজিম উদ্দিন আহমেদ এবং এমএ কাশেম সিন্ডিকেটের হাতে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই জিম্মি হয়ে আছে। এ দুজন ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বেনজির আহমেদ, রেহেনা রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান ও আজিজ আল কায়সার টিটো এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেন সুফী সাগর সামস।
তার দাবি, আজিম-কাশেম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অমান্য করে আটটি কমিটির বিপরীতে ২৫টি কমিটি গঠন করে অতিরিক্ত সিটিং অ্যালাউন্স আদায় করেন। এসব কমিটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছেন তারা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ-অবৈধ সব কমিটিতেই আজিম বা কাশেম নিয়ম বহির্ভূতভাবে সদস্য হন।
এরপর ২৬ অক্টোবরও মানববন্ধন করা হয়। সেখানেও আজিম উদ্দিন ও এম এ কাশেম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একই ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়।
বিএসডি/ এসএ