জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। কিন্তু ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের নানা ঘটনা সেই অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। সম্প্রতি নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর চরিত্র নিয়ে বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটানো হচ্ছে।
এগুলো বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি নীতিমালা প্রণয়নের মতামত ব্যক্ত করেছেন মানবাধিকার ও নারীর অধিকার আদায়ে সোচ্চার নেতৃবৃন্দ।
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর-১০ ডিসেম্বর) ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে “নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ : মানবাধিকার লঙ্ঘন” বিষয়ক অনলাইন মতবিনিময় সভা আজ রোববার (১২ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত হয়েছে।
‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ কর সম-অধিকার নিশ্চিত কর’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে অনলাইনে অনুষ্ঠিত সভায় এসব কথা বলেন তারা।
মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে আজকে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে আছে। কিন্তু ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের নানা ঘটনা সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। ধর্ষণ কেন হচ্ছে এর মূল কারণ উদঘাটন করতে হবে বলে তিনি মত দেন।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ৪০টার উপরে ‘কেস মিটিং’ করা হয়েছে এবং সকল মন্ত্রণালয় ও সংবাদমাধ্যমে এসব ব্যাপারে কথা বলা হয়েছে। তবে সরকার ও মানবাধিকার কমিশনের একার পক্ষে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ।
মহিলা পরিষদ সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আমরা দেখছি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। আমরা লক্ষ্য করছি এই সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সহিংসতা বন্ধ করতে হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি সংগঠনের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
তিনি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূলের বিষয়ে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন ও আলোচনা করে জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, যারা মানবাধিকারের সুরক্ষা দেবেন তাদের মানবাধিকারের বিষয়টা জানা জরুরি। আমাদের সংবিধানে সবার মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আইন করার পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা।
সহসাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা শুধু নারীর একার জন্য অপমান নয়, এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অপমানজনক। নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে এবং বিনির্মাণে সকলকে সাথে মানবাধিকার সংগঠনকে সাথে নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে কাজ করার আহ্বান জানান।
আলোচকের বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন খন্দকার ফারজানা রহমান, কোভিডকালে নারীর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। নারীকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অবমাননা করা হচ্ছে। উচ্চপদে থাকলেও নারীদের তুচ্ছ ভাবা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ বৈশ্বিক লিঙ্গসূচক, মানবাধিকার সূচকে এগিয়ে আছে তবুও নারীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
দীপ্ত টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, নারী নির্যাতনের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো বই, কাগজ-কলমে আটকে থাকে। অনেকক্ষেত্রে সময়মত সংবাদও আসে না। জেন্ডার ইস্যু নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এস এম মাসুম বিল্লাহ বলেন, ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করা জরুরি। এই বিষয়ে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্রে বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। দেশে প্রচলিত বিচারব্যবস্থা জেন্ডার সংবেদনশীল করতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, জনপ্রতিনিধি, তাদের সাথে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় সভা করা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন জানান, ধর্ষণ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকায় ৫৬ হাজার ২৬৭টি নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে কাজ করেছি। যার মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণের ফলে কারো মৃত্যু হলে সেখানে যে রিপোর্ট হচ্ছে তাতে নিহতের পরিবার কোনো সহায়তা পাচ্ছে না।
একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে তার সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া কিন্তু পুরুষদের সব অপরাধ সমাজে বৈধতা দেওয়া হয়। নারীর চরিত্র নিয়ে বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটনা করা হয়। এগুলো বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করেন তিনি।
সভায় মহিলা পরিষদের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইনজীবী অ্যাড. দীপ্তি সিকদার। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাড. জেসমিন সুলতানা, মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত আন্দোলন সম্পাদক রেখা চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, লিগ্যাল এইড সম্পাদক সাহানা কবীর, অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক এবং গণমাধ্যম সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) রীনা আহমেদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, রোকেয়া সদন সম্পাদক নাসরিন মনসুর, স্বাস্থ্য সম্পাদক ডা. সামিনা চৌধুরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠক, সাংবাদিক, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দ এবং কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মহিলা পরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক অ্যাড. মাকছুদা আখতার।
বিএসডি/এসএ