স্কুল-কলেজ শুরু ও ছুটির ব্যস্ততম সময়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পারাপারের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একইসঙ্গে ব্যস্ততম সড়ক, রেললাইন বা ফুটপাত ধরে হাঁটার সময় শিক্ষার্থী,পথচারীদের সবাইকে আইন মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সড়কে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে উত্তেজিত হয়ে কেউ যেন গণপরিবহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ না করে আইন নিজের হাতে তুলে না নেন।
বুধবার সকালে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি সড়কে নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিজ উদ্যোগে বিশেষ ট্রাফিকের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নিজস্ব লোক থাকতে হবে যেন ছেলেমেয়েরা নিরাপদে সড়ক পার করতে পারে। ট্রাফিক পুলিশ স্কুল কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করবে।’
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি জোরদার করে তুলেন শিক্ষার্থীরা। সড়কে নানা অনিয়মও প্রকট হয়ে উঠে তখন। সরকারও সমালোচনার মুখে পড়ে।
শেখ হাসিনা সড়কে এই মৃত্যুতে সমবেদনা ও শোক জানিয়ে বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের বলব, রাস্তায় চলাচল করার জন্য ট্রাফিক রুলস মেনে চলতে হবে। প্রতিটি স্কুল-কলেজে ট্রাফিক রুলস শিক্ষা দেওয়া উচিত। সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
মহাসড়কে টানা গাড়ি চালিয়ে চালক ও হেলপাররা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাদের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বিশ্রামাগার স্থাপনের কথাও ভাবছে সরকার।
পাশাপাশি দেশে চালক সঙ্কট নিরসনে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। চালকরা যেন সহজে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যান, সেদিকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন তিনি।
সড়কে দুর্ঘটনার পর চালক-শ্রমিককে মারধর, গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মতো কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘অনুরোধ করব সকলের কাছে, দুর্ঘটনা কেন ঘটল, কী কারণে ঘটলো, সেটা খুঁজে দেখা দরকার। কিছু হলেই গাড়ি পোড়াবেন, চালককে গণপিটুনি দেবেন, এটা ঠিক না। আইন কেউ হাতে তুলে নিবেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, তারা দেখবে আইনগত ব্যবস্থা কী নেওয়া যায়।’
প্রধানমন্ত্রী এদিন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নবনির্মিত ঢাকা এয়ারপোর্ট মহাসড়কে শহিদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন পথচারী আন্ডারপাস, সিলেট শহর বাইপাস-গ্যারিসন লিংক চার মহাসড়ক, বালুখালী (কক্সবাজার)-ঘুমধুম (বান্দরবান) সীমান্ত সংযোগ সড়ক এবং রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর চেংগী নদীর উপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতুর উদ্বোধন করেন।
প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনের মাধ্যমে আমরা তৃণমূল জনগণের কাছে দেওয়া বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছি। যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, কল্পনা করতেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ১৩ বছরে যে আর্থ-সামাজিক উন্নতি আমরা করতে পেরেছি সেটা আমাদের দেশের তৃণমূল মানুষের প্রতি যে প্রতিশ্রুতি ছিল সেটারই বাস্তবায়ন।’
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্প গুলোর সঙ্গে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন।
প্রকল্পগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ এবং ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন বিগ্রেডের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণভবন প্রান্তে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেন, শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক নেতারা প্রকল্প প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং চিফ মেজর জেনারেল ইবনে ফজল সায়েখুজ্জামান স্বাগত বক্তৃতা করেন।গণভবন প্রান্তে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। এছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রকল্পের সার্বিক দিক তুলে ধরেন।
শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজসংলগ্ন পথচারী আন্ডারপাস প্রকল্প
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কে শহিদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজসংলগ্ন দৃষ্টিনন্দন পথচারী আন্ডারপাসটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫৭ দশমিক ৪২ কোটি টাকা।
আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এ ধরণের আন্ডারপাস দেশে এটিই প্রথম। এটির দৈর্ঘ্য ১৩৫ মিটিার এবং প্রস্থ ৫ মিটার। এর অভ্যন্তরে ত্রিকোণাকৃতির দৃষ্টিনন্দন সুরসপ্তক ডোম, ৩২০ মিটার র্যাম, ৬৭৮ মিটার ফুটপাত এবং ৭৬৩ মিটার বাউন্ডারি ওয়াল এবং প্রতিবন্ধী এবং বয়োবৃদ্ধদের চলাচলের জন্য বিশেষ সুবিধাদি রয়েছে। এতে দুটি লিফট এবং চলন্ত সিঁড়ি রয়েছে। এটি নির্মানে আধুনিক বক্স পুসিং টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে নির্মাণাধীন সময়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৯ জুলাই এয়ারপোর্ট মহাসড়কে শহিদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজিব ও দিয়া খানম মিম। এরপর প্রধানমন্ত্রী এ এলাকার জনগণের পারাপারের জন্য তাৎক্ষনিকভাবে এই আন্ডারপাস নির্মাণের নির্দেশ দেন।
সিলেট শহর বাইপাস-গ্যারিসন লিংক ৪-লেন মহাসড়ক প্রকল্প
৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সিলেট গ্যারিসন লিংক রোড প্রকল্পটি নির্মাণের ফলে সিলেট বাইপাস থেকে কানাইঘাট এবং শাহ পরাণ সেতু ঘাট থেকে সিলেট শহর বাইপাস পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দ্রুত আর সহজতর হয়েছে। ২৭৪ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবগঠিত ১৭ পদাতিক ডিভিশনে একটি ‘এডুকেশন ভিলেজ’ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে যাতে একটি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, আর্মি ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনেষ্ট্রেশন, ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং সমাজের প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ‘ঢাকা প্রয়াস’ স্কুলের আদলে ‘সিলেট প্রয়াস’ স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে।
নবনির্মিত এই সড়কটি স্থানীয় স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াত আরও সহজতর ও নিরাপদ করবে। এছাড়া স্থানীয় জনসাধারণের বাণিজ্যিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও এই প্রকল্পটি ব্যাপক অবদান রাখবে।
বালুখালী (কক্সবাজার)-ঘুনধুম (বান্দরবান) সীমান্ত সংযোগ সড়ক প্রকল্প
৭৮ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়কটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২ কি.মি.। প্রস্থ প্রায় ৫৯ ফুট। এই মহাসড়কটি নির্মাণে ৭ দশমিক ৫৮ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। ৫টি কালভার্ট, সাইড ড্রেন এবং ক্রস ড্রেনের কাজও এতে রয়েছে।
এ সড়কটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সংযোগ স্থাপন করবে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। ফলে স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতে এই সড়কটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সড়কটি সীমান্ত সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচরে চেংগী নদীর উপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু প্রকল্প
রাঙ্গামাটি কাপ্তাই হ্রদ বেষ্টিত একটি জেলা। বর্ষাকালে যখন কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর বৃদ্ধি পায়, তখন অতিমাত্রার ঢেউয়ের কারণে দেশীয় ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল বন্ধ থাকে। এছাড়া গ্রীষ্মকালে পানির স্তর অস্বাভাবিক ভাবে কমে যাওয়ায় এসকল নৌযান চলাচলে বাধার সম্মুখীন হয়। এ পরিস্থিতিতে জেলা সদরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এই অঞ্চলের মানুষের রাঙ্গামাটি জেলা সদর কিংবা বিভাগীয় সদর চট্টগ্রামে গমনাগমন বাধাগ্রস্ত হতো। বছরের বেশিরভাগ সময় এ জনপদের মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পার করত।
পার্বত্য অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ৫০০ মিটার দীর্ঘ নানিয়ারচর সেতুটি নির্মাণের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি জেলা সদরের সঙ্গে নানিয়ারচর উপজেলার নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলো, যা ভবিষ্যতে লংগদু উপজেলা হয়ে মারিষ্যা পর্যন্ত বাড়ানো হবে।
বিএসডি/ এলএল