নিজস্ব প্রতিবেদক:
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরিফ হোসেন। ৫০ পেরুনো এই পুরুষের সঙ্গে ট্যানট্যান নামের একটি মোবাইল ফোনের ডেটিং আ্যাাপসের মাধ্যমে পরিচয় হয় সোনিয়া মেহের নামে এক নারীর। দীর্ঘদিন হোয়াটস অ্যাপসের কথা বলার এক পর্যায়ে আরিফকে ডেকে নেয়া হয় একান্তে সময় কাটানোর জন্য। ১৮ বছর বয়সি নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য ছুটে যান মেহেরের যাত্রাবাড়ীর বাসায়। তবে সেখানে যাওয়ার পরই ঘটে বিপত্তি। নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও তুলে আটকে রাখা হয় আরিফকে। দাবি করা হয় ৪০ লাখ টাকা। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বাকিটা পরে পরিশোধের শর্তে মুক্তি পান তিনি। এরপর ছুটে যান সংশ্লিষ্ট থানায়। মামলা দায়েরের পর তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশনের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। এ ঘটনায় সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয় সোনিয়া মেহের, তার বাবা আবদুল জলিল হাওলাদার ও তাদের সহযোগী ইউসুফ মোল্লাকে। মামুন, রাজু, বিথী, মিথিলাসহ একাধিক নারীকে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, শুধু আরিফ হোসেনই নয়, এ ধরনের অ্যাপসের মাধ্যমে নারীদের সঙ্গে যোগাযোগের পর অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের তদন্তে উঠে এসেছে। তাদের কাছ থেকেও হাতিয়ে নেয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা। তারা সবাই ট্যানট্যান, মামবা ও টিনডার আ্য্যপস ব্যবহার করে বিপদে পড়েছেন বলে জানা গেছে। মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে তারা এতদিন নিশ্চুপ ছিলেন। তবে পুলিশি অভিযানে গ্রেফতারের পর তারা এখন মুখ খুলছেন। এ ধরনের ডেটিং অ্যাপসে সুন্দরী নারীর ছবি ব্যবহার করেও প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশনের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার জানান, এই চক্রের একাধিক সদস্য রয়েছে। তারা ত্রিশোর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিরিবিলি ¯’ানে ডেকে নেন। এরপর তাদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নি”েছ। এ ধরনের একাধিক ভুক্তভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার মেহের এ পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ জনকে জিম্মি করে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। তবে ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে আইনগত ব্যব¯’া না নেয়ায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হ”েছ না। তবে পুলিশি নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, ট্যানট্যান, মামবা ও টিনডার অ্যাপসসহ আরো অন্তত ১৫টি আ্য্যপসের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলে নারী ও পুরুষরা বন্ধুত্ব তৈরি করে। এরপর তারা দেখা ও একান্তে সময় কাটান। এ জন্য চাহিদামতো টাকাও পরিশোধ করা হ”েছ। আবার অনেক ক্ষেত্রে ডেকে নিয়ে সময় কাটনোর কথা বলে আটকে রাখা হয়। এরপর তার পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া । আ্য্যপসগুলো মূলত অসামাজিক কাজেই ব্যবহার হয়। এ ধরনের একটি ঘটনায় গত ২৮ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন এক ভুক্তভোগী। পরে ওই মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে গ্রেফতার করা হয় মেহের এবং তার বাবা আবদুল জলিল হাওলাদার ও তাদের সহযোগী ইউসুফ মোল্লাকে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মেহের পুলিশকে জানায়, তাদের এই অপকর্মের জন্য শনিরআখড়া এলাকায় তারা একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিল। ওই বাসা ভাড়ার টাকাও দেয়া হতো জিম্মি করে পাওয়া অর্থ থেকে। তারা একটি গাড়ি ভাড়া করেছিল। পুলিশ পরিচয়ে তাদের সঙ্গীরা ঘুরে বেড়াতেন। গ্রেফতার মেহের এসএসসি পাস। সংসারে অভাবের কারণেই বাবা-মেয়ে এ পথে পা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। তার কাছ থেকে ৪টি মোবাইল ফোন সেট ও ৮টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। তার মোবাইলে একাধিক ডেটিং অ্যাপস রয়েছে। ভিন্ন নামে নামে রয়েছে একাধিক আইডি। সেখানে দেখা গেছে তার একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা তার কাছে প্রতারিত হয়েছেন তাদের ব্লক করে রাখা হয়েছে। সে মাঝে মধ্যেই নিজের প্রোফাইলে অন্যের ছবি ব্যবহার করতেন। কারণ হিসেবে সে ডিবিকে ব্যাখ্যা দেন, সুন্দরী নারীদের বয়স্ক পুরুষরা বেশি পছন্দ করে। এ কারণে বিভিন্ন নারীর ফেসবুক থেকে ছবি নিয়ে তা ডেটিং অ্যাপসের প্রোফাইলে ব্যবহার করতেন।
সূত্রমতে, এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আরো একটি নতুন অভিযোগ পায় ডিবি পুলিশ। সেখানে দেখা যায়, অন্য নারীর ছবি ব্যবহার করে প্রতারণা করেছে আরেকজন। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ ওই নারীকে আটক করে। কিš‘ সেখানে দেখা যায়, ওই নারী এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। এরপর পুলিশি তদন্তেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীর সন্ধান করছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশনের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ মুহিদুল আলম জানান, গ্রেফতার মেহেরের দেয়া তথ্যমতে তারা এ পর্যন্ত অন্তত ২০ জনকে জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই টাকা দিয়ে তারা বাসা ও গাড়ি ভাড়াসহ নিজেদের খরচ মেটাতেন। জিম্মি থেকে পাওয়া টাকার অর্ধেকের বেশি নিতো মেহের ও তার বাবা। বাকি টাকা চক্রের অন্য সদস্যদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। মূলত তারা বয়স্ক পুরুষদের টার্গেট করেন। কারণ ছাত্র বা বেকারদের কাছে বেশি পরিমাণ টাকা থাকে না। বয়স্করা পয়সাওয়ালা হয় বলে তাদের ধারণা। ওই ধারণা থেকেই তারা বয়স্কদের টার্গেট করে আসছিল।
তিনি বলেন, অনেক সময় তারা অন্যের ছবি (সুন্দরী নারী) ব্যবহার করে অ্যাপসে অ্যাকাউন্ট খুলতেন। সুন্দরী নারী হওয়ার কারণে তাদের সঙ্গে অনেকেই বন্ধুত্ব করতেন। কিš‘ বাস্তবে দেখার পর অনেকে তার সঙ্গে সময় না কাটিয়ে চলে আসতে চাইলেই চক্রের অন্য সদস্যরা সেখানে হাজির হন। এরপর নিজেদের পুলিশ পরিচয়ে টার্গেট ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে তাদের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর আরো একাধিক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও তুলে দাবি করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা না দিলে মারধরের পর এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। অনেকে ভয়ে টাকা দিয়ে সেখান থেকে মুক্তি নিয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, এ ধরনের একাধিক ঘটনার পর তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ডেটিং অ্যাপস বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন। একই সঙ্গে অপরিচিত নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে দেখা না করারও পরামর্শ দিয়েছেন ডিবির এই কর্মকর্তা।
বিএসডি/ এলএল