নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকার তামাক উৎপাদন ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি বিভাগ তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তথাপি নেত্রকোনার বিভিন্ন এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে এই ক্ষতিকর দ্রব্যের চাষাবাদ। কম খরচে অধিক লাভের আশায় কৃষকরা তাদের ধানি জমিতে তামাকের চাষ করছেন।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে এলাকার শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের শত শত মানুষ।
জানা যায়, প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে ফসল ঘরে তোলার পর জেলার অধিকাংশ এলাকায় বোরো ধানের চাষাবাদের কাজ শুরু হয়। বিপরীত চিত্র কেন্দুয়া উপজেলার ১০-১২টি গ্রামে। এসব গ্রামের কৃষক তাদের জমিতে তামাক চাষ করেন। পাইকুড়া ও চিরাং ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে বছরের পর পর বছর ধরে এই অবস্থা চলে আসছে। গত বছর তারা ২৫ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ করেছিলেন। এবার করেছেন ৩০ হেক্টর জমিতে।
এই প্রতিবেদক রবিবার পাইকুড়া ইউনিয়নের মজলিপুর, উত্তরাটি, চিটুয়া, নওপাড়া, বৈরাটি এবং চিরাং ইউনিয়নের ছিলিমপুর, দুল্লী ও পূর্বরায়সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পরির্দশন করেন। এ সময় দেখা যায় যে, শিশু থেকে প্রৌঢ়- বিভিন্ন বয়সের মানুষ তামাক ক্ষেতের দেখাশোনার কাজ করছেন। গাছ বেশ বড় হয়েছে। কদিন পরই শুরু হবে সংগ্রহের কাজ।
এলাকার একজন সচেতন নাগরিক চিরাং গ্রামের মোস্তাক আহম্মেদ জানান, এবার কমপক্ষে ৩০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। এতে শতাধিক পরিবারের সহস্রাধিক মানুষ যুক্ত আছে। নারী ও শিশুও রয়েছে তাদের মধ্যে। মাঘ-ফাল্গুন মাস ফসল ঘরে তোলার সময়। প্রতিবছরই এ সময়টাতে নারী ও শিশুদের হাঁচি, কাঁশি, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়।
এদিকে কৃষকরা মনে করেন, সব ফসলেরই গন্ধ থাকে। তামাকেরও আছে। এতে কোনো ক্ষতি হয় বলে তাদের জানা নেই। দুল্লী গ্রামের কৃষক তাজ উদ্দিন জানান, বাপ-দাদার আমল থেকেই তামাক চাষ করে আসছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘তামাক চাষ করায় তারার কোনো ক্ষতি অইছে না। এ ছাড়া জমিতে অন্য ফসল চাষের তুলনায় তামাক চাষের খরচ কম, লাভ বেশি। গত বছর তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছিলাম। এই বছর পাঁচ বিঘা জমিতে চাষ করছি’।
আব্দুল আলী নামে একজন কৃষক জানান, এক বিঘা জমিতে তামাক চাষ করতে বীজ বপণ, নিড়ানি, পানি দেওয়া ও কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচ হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। তামাক উৎপাদন হয় ১০ মণের মতো। প্রতিমণ তামাক গড়ে আড়াই হাজার করে মোট ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সেই হিসেবে এক বিঘা জমির তামাক খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় ১৭ হাজার টাকার বেশি। এর বিপরীতে কৃষক যদি ধান চাষ করেন, তাহলে এক বিঘা জমিতে খরচ পরে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে বোরো ধান উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ ৩০ মন। এই পরিমাণ ধানের বাজার মূল্য ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কৃষকদের লাভ হয় ৪ হাজার টাকা। চাষে ঝুঁকিও বেশি। তাই ধানের চেয়ে তামাক চাষ বেশি লাভজনক।
চিকিৎসকদের মতে, তামাক চাষ যে এলাকায় হয়, সেই এলাকার শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তামাকের উপাদান বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে। তাই তামাক সেবন না করলেও, আশপাশে যারা থাকে, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা, তারাও আক্রান্ত হতে পারে। যেসব কৃষক তামাক চাষের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের হৃদরোগ ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এ ব্যাপারে কেন্দুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এ কে এম শাহজাহান কবীর বলেন, উপজেলায় আনুমানিক ১৫-২০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে। আমরা তাদের অন্যান্য ফসল চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ এফ এম মোবারক আলী বলেন, কেন্দুয়া উপজেলার কিছু এলাকায় তামাকের চাষ হয় বলে শুনেছি। কৃষকরা যাতে তামাক চাষ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসেন, সে লক্ষ্যে কাজ করার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।