বাজারে সংকট নেই। আমদানি করা চালও আসছে প্রতিনিয়ত। মাঠ থেকে উঠেছে বোরো ফসল। তারপরও বাড়ছে চালের দাম। সরকার কঠোর হচ্ছে না দেখে ব্যবসায়ীদের কাছে দাম বাড়ানোটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলে তারা একে অন্যকে দায়ী করে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেন।
বলতে গেলে সরকারের কোনও মহলই বাজারে চালের দামে নজরদারি করছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে চালের বাজারে সরবরাহ ও আমদানি পরিস্থিতি দেখার দায়িত্ব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। কৃষি মন্ত্রণালয় মনে করে বাজার দরের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। আর ব্যবসায়ীদের কথা একটাই- চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম।
সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির তথ্যেও মিলেছে চালের দাম বাড়ার প্রমাণ। তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে টিসিবির দেওয়া দামেও বেশ ফারাক আছে।
রাজধানীর শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের মোকাম খ্যাত নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও জয়পুরহাটের আড়তে দাম বাড়লে তার প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। তাদের কথা হলো, কমিশনের বিনিময়ে রাজধানীর ব্যবসায়ীরা চাল বিক্রি করেন। চালের দাম বাড়লে তাদের কোনও লাভ নেই। অর্থাৎ সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজধানীর ব্যবসায়ীরা যুক্ত নয়। একচেটিয়া লাভ যদি কিছু হয় তা মোকামেই হয়।
এদিকে পাড়া-মহল্লার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের কারণেই চালের দাম বাড়ে। এবারও বেড়েছে। বারবার বিধিনিষেধের কারণে চাল সরবরাহে নিয়োজিত ট্রাক ভাড়া বাড়ে।
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ট্রাক মালিকরা। তাদের দাবি, করোনার কারণে ট্রিপ কমে গেছে। তাই লোকসান ঠেকাতে কম দামে পণ্য পরিবহন করি। আগে বগুড়া থেকে একটা ট্রাক ঢাকায় পাঠাতাম ১৮ হাজার টাকায়। এখন পাই ১৪-১৬ হাজার টাকা।
খুচরা ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণায় চালের বিক্রিতে চাপ বাড়ে। হুট করে বাড়তি চাহিদা দেখা দেয়। এ সময় নানামুখী গুজবও ছড়ায়। অনেকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিনে রেখেছেন। আবার লকডাউনের মধ্যে অনেক মিল মালিকই চালের সরবরাহ ইচ্ছে করে কমিয়ে দিয়েছেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করাই তাদের উদ্দেশ্য।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দাম বাড়ার এই তালিকায় রয়েছে মাঝারি মানের পাইজাম, লতা ও মোটাচাল। এখন মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকায়। যা আগে ছিল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা। অপরদিকে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, যা আগে ছিল ৪৫ থেকে ৫২ টাকা।
মিনিকেট ও নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৬ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। বিধিনিষেধ ঘোষণার আগে ছিল ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা কেজি।
টিসিবির দেওয়া তথ্যমতে, বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে। যদিও এই দরে দেশের কোথাও নাজিরশাইল বা মিনিকেট পাওয়া যায় না। টিসিবি বলেছে, এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫২ টাকা দরে। মাঝারি মানের চাল ১ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৬০ টাকায়।
ক্রেতারা বলছেন, করোনা মহামারিতে একদিকে মানুষ মরছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা অমানুষের মতো আচরণ করছেন। দাম নিয়ন্ত্রণেও কেউ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সব চাপ পড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। এটা নিয়ে কোনও দফতরই টুঁ-শব্দ করছে না।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেসব আমদানিকারক ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এলসি খুলেছেন, কিন্তু চাল বাজারজাত করতে পারেননি, তাদের এলসি করা সম্পূর্ণ চাল বাজারজাতকরণের জন্য ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
অপরদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শর্তে বেসরকারি পর্যায়ে ৩২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। যা দেশের বাজারে প্রবেশের প্রক্রিয়ায় আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বাজারে চালের সংকট নেই। কাজেই এই অজুহাতে দাম বাড়ানোর যুক্তিও নেই। বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটর করা হবে। তিনি আরও জানান, আমদানি করা চাল প্রতিদিনই বাজারে আসছে। এতে দাম ক্রমশ কমার কথা।