নিজস্ব প্রতিবেদক:
বায়ু দূষণের মাত্রাকে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি’ বর্ণনা করে ঢাকা ও আশপাশের পাঁচ জেলার অবৈধ সব ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও আজিপুরের জেলা প্রশাসক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করে অবিলম্বে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
মানবাধিকার ও পরিবেশবাদি সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)’র সম্পূরক আবেদনের শুনানির পর আজ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আমাতুর করিম। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মইনুল হোসেন।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ পরে বলেন, ইটভাটা ধ্বংসের নির্দেশনার আগে আদালত পরিবেশ অধিদপ্তর ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে আদালত উষ্মা প্রকাশ করেছেন। আদালত বলেছেন, কেউ জেগে ঘুমাতে পারবে না। কারণ বায়ু দূষণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এ আইনজীবী আরো বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আদালত পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালত বলেছেন, পরিবেশ অধিদপ্তর কতটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে? সেমিনার করে ভালো ভালো কথা বললে হবে না। বায়ু দূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু আদেশ দেওয়ার পরও কেন অবৈধ ইটভাটা বন্ধ হচ্ছে না, সে প্রশ্নও রেখেছিলেন আদালত।
অবৈধ ইটভাটা ধ্বংসের পাশাপাশি ইটভাটা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের স্থপানাও ধ্বংস করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
ঢাকায় বায়ু দূষণ ও অবৈধ ইটভাটা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে গত ৩০ জানুয়ারি একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সে আবেদনের শুনানির পর ঢাকার বায়ু দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের আগের নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ না থাকায় সংশ্লিষ্ট পাঁচ জেলার (ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজিপুর) জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ডাকেন হাইকোর্ট।
অবৈধ ইটভাটার তালিকা নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়াল আদালতে তাদের যুক্ত থাকতে বলা হয়েছিল। এ ছাড়া বায়ু দূষণ রোধে গত দুই মাস (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) পরিবেশ অদিদপ্তরের ভ্রম্যমাণ আদালত কী কাজ করেছে, তার একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয় পরিবেশ অদিদপ্তরের মহাপরিচালককে।
নির্দেশ অনুযায়ী গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের পক্ষে আরডিসি আদালতে যুক্ত হন। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক বা তার পক্ষে কোনো প্রতিনিধি আদালতে ছিলেন না। সেদিন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ আদালতে বলেছিলেন, ঢাকা ও আশপাশের পাঁচ জেলায় অবৈধ ইটভাটা ৩১৯টি। পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৯৫টি ইটভাটার কার্যক্রম একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর মামলাটিতে আদেশের জন্য রেখেছিলেন আদলত। সেই ধারাবাহিকতায় অবৈধ ইটভাটা ধ্বংসের আদেশ হল।
আদেশের পূর্বাপর
ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন যুক্ত করে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) পক্ষে রিট আবেদন করা হয়। আবেদনের শুনানি নিয়ে ওই বছর ২৮ জানুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেন। ঢাকা শহরে যারা বায়ু দূষণের কারণ সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুই বার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সেদিন নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া রাজধানীর যেসব জায়গায় উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ চলছে, সেসব জায়গা ওই আদেশের ১৫দিনের মধ্যে এমনভাবে ঘিরে ফেলতে বলা হয়েছিল যে, যাতে শুকনো মৌসুমে ধুলো ছড়িয়ে বায়ু দূষণ বাড়তে না পারে। পাশাপাশি ‘ধুলোবালি প্রবণ’ এলাকাগুলোতে দিনে অন্তত দুই বার করে পানি ছিটাতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল।
এসব নির্দেশনার পাশাপাশি আদালত সেদিন রুলও জারি করেছিলেন। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধে প্রশাসনের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছিল রুলে।
বন ও পরিবেশ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিএমপি কমিশনার, রাজউকের চেয়ারম্যানসহ ১১ বিবাদিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। এই আদেশের তিন মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন আদালত।
ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, আদালত তার একটি প্রতিবেদন চান পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হকের কাছে।
এরপর এক সম্পূরক অবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্ট ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার বায়ু দূষণ কমাতে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের জন্য পরিবেশ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
এ ছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ এলাকায় যেসব ইটভাটা অবৈধভাবে বা পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে চলছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সেগুলো ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধ করতে বলেন। আর প্রয়োজনে অতিরিক্তি লোকবল নিয়োগ করে রাস্তা, ফুটপাথ, ফ্লাইওভার, ওয়াকওভারের যেসব জায়গায় ধুলাবালি, ময়লা বা বর্জ্য-আবর্জনা জমিয়ে রাখা হয় বা জমে থাকে সেসব ধুলাবালি, ময়লা, বর্জ্য-আবর্জনা সাত দিনের মধ্যে সিটি করপোরেশনকে অপসারণ করতে বলেন।
এরপর রিটকারী পক্ষের আরেক আবেদনের আদালত ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি আরো কয়েকটি নির্দেশনা দেন।
এক. যেসব যানবাহন নির্ধারিত মাত্রার বেশি কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে সেগুলো জব্দ করতে হবে।
দুই. সড়ক পরিবহন আইনের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক যানবাহনের ‘ইকোনোমিক লাইফ’ নির্ধারণ এবং যেসব পরিবহনের ‘ইকোনোমিক লাইফ’ পেরিয়ে গেছে, সেসব পরিবহন নিষিদ্ধে ব্যবস্থা করতে হবে।
তিন. পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া টায়ার পোড়ানো বা ব্যাটারি রিসাইকেলিং বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
চার. নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজিপুর ও মানিকগঞ্জে যেসব অবৈধ ইটভাটা এখনও বন্ধ করা হয়নি, সেগুলা বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে হবে।
উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনার পর করোনাভাইরাস মহামাহীর মধ্যে ঢাকার বায়ুমানের কিছুটা উন্নতি হলেও সম্প্রতি ঢাকার বায়ু দূষণ আবারও চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। সম্প্রতি সম্পূরক আবেদন করে তা আবার নজরে আনে এচআরপিবি।
বিএসডি/ এলএল