বর্তমান সময় ডেস্ক:
মহামারির কারণে সৃষ্ট নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তথ্য শেয়ার, মানবীয় যোগাযোগ, তথ্য সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে ইন্টারনেট ও ইনোভেশনের প্রভাব অপরিহার্য। বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত প্রচারণা ও জনসংযোগের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো ডিজিটাল মাধ্যম। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়েও বিশেষ ভূমিকা রাখছে প্রভাবশালী এ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো।
উপনিবেশবাদের ধরন বদলেছে। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর শাণিত বুদ্ধিমত্তার জোরে বিশ্বকে কোনঠাসা করে ইউরোপের একচেটিয়া শাসনের অবসান হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর ভর করে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ থেকে বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র চলে যায় আমেরিকার হাতে। আমেরিকার একচেটিয়া রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তৈরির পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান যেমন ছিল, ভাঙন ধরার পেছনেও সেই প্রযুক্তির বিকাশই অনেকাংশে দায়ী। একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাশিয়া ও চীন আমেরিকার চোখে চোখ রেখে ভূ-রাজনীতির হিসাব দিচ্ছে পাল্টে। প্রযুক্তির প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে অর্থনীতিতে, পাশাপাশি রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ সব স্তরেই এর ছাপ পাওয়া যায়।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব থেকে থাই নারীদের দূরে রাখতে দেশটির সরকার ২০০৭ সালের কম্পিউটার ক্রাইম অ্যাক্ট অনুযায়ী ছবি শেয়ার নিষিদ্ধ ও আইন ভঙ্গকারীকে ৫ বছরের কারাদণ্ড রেখে বিধান করে। এসবই আসলে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, যা অনেকের কাছে ডিজিটাল সাম্রাজ্যবাদ হিসেবেও পরিচিত।
ইন্টারনেট অফ থিংসের (আইওটি) ওপর ভিত্তি করে বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটবে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পঞ্চম প্রজন্মের থাকবে বিশেষ ভূমিকা। বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে পঞ্চম প্রজন্ম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে এক তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পঞ্চম প্রজন্মের বিশাল বাজার সৃষ্টি হবে। এর সঙ্গে ভবিষ্যত অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি। ২০৩৫ সালের মধ্যে কেবল পঞ্চম প্রযুক্তিই বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার ও ২২ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান অনুমান করা হয়েছে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এই বিপুল পরিমাণ অর্থনীতি তেল কিংবা অতীতের সব ধরনের উৎসের চেয়ে বেশি মূল্যবান। ফলে, বিশ্ব রাজনীতিতে এর বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর লড়াই চলবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি অপরাধ সংঘটিত হবার আগেই সে সম্পর্কে জানতে পারবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পনা পর্যায়ে অপরাধ চিহ্নিত করে তা ঠেকানো যাবে, যেখানে কাজ হবে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশিং একটি ব্যবস্থা। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের কিছু পুলিশ বাহিনী ইতোমধ্যেই ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশিং ব্যবহার বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করেছে।
আবার কিছু প্রযুক্তি দিয়ে একটা অপরাধ খুব সহজে প্রমাণ করা যায়, ফলে বিচার কার্যক্রম সহজ ও গতিশীল হতে পারে। যেমন: ডিভাইস ট্রাকিং, আইপি লোকেশন চিহ্নিত করা, ফোন কল ট্রাক করা ইত্যাদি। এজন্য কিছু নজরদারিমূলক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়, যা নিয়ে আবার অনেক বিতর্ক ও রয়েছে। বিশেষ করে পক্ষপাতমূলক ব্যবহার ও নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার খর্ব করা।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ফোনালাপ ফাঁসের মতো ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়, যা রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তার জন্যে হুমকিস্বরূপ। একটি রাজনৈতিক সরকার তার প্রতিপক্ষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তাদের প্রাইভেসি লঙ্ঘন করছে, বিশ্বব্যাপী যার বহু উদাহরণ দেখা যায়। এ ছাড়া চীন, রাশিয়া, ফিলিপিন্স, মিয়ানমারসহ বহু দেশের সরকার রাষ্ট্রের বিশিষ্ট নাগরিক, অধিকার কর্মী বা আন্দোলনকারীদের ওপর নজরদারি করে তাদের দমন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহামারির মধ্যে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী জেফ বেজোসের ব্যক্তিগত সম্পদভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর তখন মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭৭ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেজোসের প্রতি সেকেন্ডে আয় ছিল ৩ হাজার ৭০০ ডলারের বেশি। এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ বেশ কয়েকটি দেশের সমন্বিত জিডিপির চেয়েও বেশি। বিশ্বের সেরা ১০ ধনীর মধ্যে অন্তত ৮ জন প্রযুক্তিখাতের। সম্পদের এমন বৈষম্য, সমাজ ও রাজনীতির প্রতিটা স্তরে প্রভাব বিস্তার করে।
সূত্র: ফোর্বস, মিডিয়াম, দ্য ইকোনোমিস্ট, স্ট্যাটিস্টা, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও ইয়াহু ডট কম।
বিএসডি/ এফএস