আন্তর্জতিক ডেস্ক:
জাপোরিজ্জিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দখলের পর রুশ সেনারা এবার ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘ইউঝনুকরাইস্ক’র দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘকে এমন তথ্য দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড।
মারিউপুলের ডেপুটি মেয়র সেরহাই অরলভ বলেন, ‘বেদখলকারীরা আমাদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে বোমা ছুড়ে যাচ্ছে। মারিউপুলে কোনো যুদ্ধবিরতি নেই।’ এদিকে ইউক্রেনের আকাশসীমায় ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করতে কিয়েভের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে ন্যাটো। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি কোনো দেশ ইউক্রেনের ওপর নো-ফ্লাই জোন আরোপ করে মস্কো তাকে সংঘাতের প্রবেশ করেছে বলে বিবেচনা করবে।
ইউক্রেন বলছে, তিন দিক থেকে বেসামরিক অবস্থান লক্ষ্য করেও নির্বিচার আক্রমণ করছে রুশ বাহিনী। কৃষ্ণসাগর উপকূলীয় ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের শহরগুলো আছে সবচেয়ে বেশি চাপে। এ ছাড়া দেশটির উত্তর ও পূর্ব দিক থেকেও হামলা চালাচ্ছে রুশ সেনারা। সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে কৌশলগত বড় বড় বন্দর আছে। এগুলোর নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে রাশিয়া।
এতে ইউক্রেনে আসা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া সহজ হবে। ইতোমধ্যে বন্দরনগরী মারিউপুল দখলে নিয়েছে রুশ সেনারা। সেখানে মানবিক সাহায্যে করিডর তৈরির আকুতি জানিয়েছিলেন শহরটির মেয়র। এরপরই পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দেয় মস্কো। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ‘স্থানীয় সময় শনিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে এ অস্ত্রবিরতি। এ সময়ে মারিউপুল ও ভলনোভাখা শহরে মানবিক করিডর চালু থাকবে। বলা হয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের শহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য পথ তৈরি করে দিতে ‘নীরবতার শাসন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ তবে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ জানায়, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করা হলেও রাশিয়া তা পুরোপুরি পালন করেনি। মারিউপুল থেকে দুই লাখ এবং ভলনোভাখা থেকে ১৫ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। অনেকেই সরে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাসিন্দাদের বলা হয়েছে, শহরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে এবং নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে। মারিউপুলের ডেপুটি মেয়র সেরহাই অরলভ বলেন, বেসামরিক লোকজন যে পথে সরে যাওয়ার কথা সেই পথের শেষভাবে বোমা ফেলছিল তারা।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড জাতিসংঘকে বলেছেন, জাপোরিজ্জিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দখল নেওয়ার পর রুশ সেনাদের টার্গেট এখন ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তিনি বলেন, রুশ সেনাদের একটি বহর ইতোমধ্যে দ্বিতীয় পারমাণবিক কেন্দ্রের মাত্র ২০ মাইল দূরে আছে। লিন্ডা কেন্দ্রটির নাম উল্লেখ না করলেও ইউক্রেনের পারমাণবিক জ্বালানি কমিটি এনারগোয়াটমের মতে, দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্রটি হলো ইউঝনুকরাইস্ক। যার অবস্থান ইউক্রেনের দক্ষিণে মাইকোলাইভ ওব্লাস্টে।
পারমাণবিক কেন্দ্রে সামান্য ভুলচুকেও ঘটে যেতে পারে চেরনোবিলের মতো মহাবিপর্যয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রদূত লিন্ডা অতিদ্রুত মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে।
রোমানিয়ার আকাশে যৌথ মহড়া : রোমানিয়ার আকাশসীমায় এক যৌথ মহড়ায় অংশ নিতে গেছে মার্কিন বি-৫২ বোমারু বিমান। রোমানিয়া ও জার্মানির সঙ্গে আকাশপথে একাত্মতার জানান দিতেই তড়িঘড়ি এ মহড়া হতে চলেছে। আর এর জন্য মার্কিন বিমানবহরের সবচেয়ে বড় বোমারুটি উড়াল দিয়েছে ইংল্যান্ডের রয়্যাল এয়ারফোর্সের স্টেশন থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইউক্রেন সাড়ে তিনশ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের প্রতিরক্ষা সামগ্রী পেয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনে প্রতিরক্ষাসামগ্রী দিতে সম্মত হয়। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র এই অস্ত্র ডেলিভারি দিয়েছে। প্রায় ২৪০ মিলিয়ন ডলার প্যাকেজের প্রতিরক্ষা সামগ্রী ইতোমধ্যে ইউক্রেনে পৌঁছেছে। বাকিগুলো কয়েকদিনের মধ্যে পৌঁছাবে। এই প্রতিরক্ষা সামগ্রীর মধ্যে ট্যাঙ্ক প্রতিরোধী বিভিন্ন অস্ত্র রয়েছে। রুশ আক্রমণের মুখে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু জেলেনস্কি তাকে সরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ইউক্রেনে নো ফ্লাই জোনকে ‘না’ ন্যাটোর : ইউক্রেনের নো ফ্লাই জোন ঘোষণার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে ন্যাটো। স্থানীয় সময় শুক্রবার ব্রাসেলসে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট এ সামরিক জোটের বৈঠকের পর এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ন্যাটোর এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, এখন থেকে যেসব মানুষ মারা যাবে, তাদের সবার মৃত্যুর কারণ আপনারা হবেন। কারণ আপনাদের দুর্বলতা, একতাবোধে ঘাটতি থাকার কারণে এমনটা ঘটবে। ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা থেকে ইউক্রেনকে সুরক্ষা দিতে গেলে ন্যাটো বাহিনীকে রুশ বিমান ভূপাতিত করতে হবে। এ পদক্ষেপে ইউরোপে পুরোদমে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে, যেখানে আরও অনেক দেশ জড়িত হবে। আমরা এ সংঘাতের অংশ নই।
রাশিয়ার তিন কমান্ডার নিহতের দাবি : রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অন্তত তিনজন কমান্ডার নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। ইউক্রেনের সেনাদের কাছাকাছি যাওয়ার পথে ইউক্রেনীয় স্নাইপারের গুলিতে তারা নিহত হন। পশ্চিমারা দাবি করছেন, নিহতদের মধ্যে ৪১তম যৌথ সশস্ত্র সেনা ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। এ ছাড়া একজন ডিভিশনাল কমান্ডার ও একজন রেজিমেন্টাল কমান্ডারও নিহত হন। এদিকে হামলা শুরুর পর রাশিয়ার ৯ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। এ ছাড়া রুশ বাহিনীর ২১৭টি ট্যাংক, ৯০টি কামান, ৩১টি হেলিকপ্টার এবং ৩০টি জঙ্গি বিমান ও অন্যান্য এয়ারক্রাফট ধ্বংস করার দাবি করেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী।
রাশিয়ার সঙ্গে আবারও বসতে চায় ইউক্রেন : ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। তবে ওই বৈঠক থেকে তেমন কোনো ফল আসেনি। এবার তৃতীয় দফা বৈঠকে বসতে চাচ্ছে ইউক্রেন। দেশটির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক এসব কথা জানান। ওই কর্মকর্তা বলেন, মস্কোর সামরিক আগ্রাসনের কারণে শুরু হওয়া লড়াই বন্ধে রাশিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তৃতীয় দফা বৈঠকে বসার পরিকল্পনা করছে ইউক্রেন। কিয়েভ চলতি সপ্তাহেই রাশিয়ার সঙ্গে এই বৈঠকে বসতে চাচ্ছে। এ নিয়ে দিনক্ষণ নির্ধারণের জন্য রাশিয়ার উত্তরের অপেক্ষায় আছে কিয়েভ।
ইউক্রেনের মানবিক সংকট নিয়ে বৈঠকে বসছে নিরাপত্তা পরিষদ : জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইউক্রেনের মানবিক সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী সোমবার জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক জানান, জরুরি এ বৈঠক শেষে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য সম্ভাব্য একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসবে। মেক্সিকো ও ফ্রান্সের প্রস্তাবে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিএসডি/ এফএস