নিজস্ব প্রতিবেদক:
সব মিলিয়ে গত ১৩ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান সূচকটি ৫৮১ পয়েন্ট বা সোয়া ৮ শতাংশ কমে গেছে। আর একই সময়ের ব্যবধানে লেনদেন ১ হাজার ২৩১ কোটি টাকা থেকে কমে গতকাল নেমে এসেছে ৭৪০ কোটি টাকায়। গত রোববার এ লেনদেন ছিল সাড়ে ৬০০ কোটি টাকায়। ১২ কার্যদিবসের ব্যবধানে লেনদেন কমে অর্ধেক হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন।
প্রধান শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকটি সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্টের মনস্তাত্ত্বিক সীমার নিচে নেমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। বাজারসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দিক থেকে এদিন শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল বেশি। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম একলাফে ১৫০ ডলারে উঠে যাওয়ার খবরকে দায়ী করেন তাঁরা। তবে মাঝারি পর্যায়ের একাধিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখন ফোর্সড সেল বা জোরপূর্বক বিক্রির আতঙ্ক ভর করেছে। গত কয়েক দিনের টানা দরপতনে অনেক শেয়ারের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। তাই ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ঋণ সমন্বয়ের চিঠি দিয়েছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ সমন্বয় করতে পারেননি তাদের অনেকের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রির আওতায় পড়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারের দাম নির্ধারিত একটি সীমার নিচে নেমে গেলে ঋণ সমন্বয়ের তাগিদ দেয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা ঋণ সমন্বয়ে ব্যর্থ হলে তখন তার পোর্টফোলিও বা পত্রকোষে থাকা শেয়ার বিক্রি করে ঋণ আদায় করেন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী গতকাল বলেন, পড়তি বাজারে চড়া সুদের হাত থেকে বাঁচতে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের অনেকে লোকসানেও শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার টানা পতনের কারণে অনেক বিনিয়োগকারী গত কয়েক দিনে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও খুব বেশি সক্রিয় নয় বাজারে। এ কারণে বাজারে ক্রেতাসংকট দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব লেনদেনেও পড়েছে।
তবে একাধিক বিনিয়োগকারী এ–ও অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তেলের দামকে বড় অসিলা হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকদের একটি অংশও মনে করেন, বাজারে অহেতুক ভীতি ছড়িয়ে এ সুযোগে কম দামে শেয়ার কেনার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বাজারে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪টি। সেই সংখ্যা গত রোববার দিন শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৭৩১টিতে। অর্থাৎ ১২ কার্যদিবসে শেয়ার শূন্য বিও হিসাব বেড়েছে ৩৫ হাজার ৬৩৭টি। তার মানে এসব হিসাব থেকে গত ১২ দিনে সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এই সময়ে নিষ্ক্রিয় বিও হিসাব সক্রিয় হওয়ার বা নতুন বিও হিসাব খুলে শেয়ার কেনার তথ্যও পাওয়া যায় না সিডিবিএলের পরিসংখ্যান থেকে। কারণ, ১৫ ফেব্রুয়ারি বাজারে শেয়ার আছে, এমন বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ১ হাজার ৬৭২টি। গত রোববার দিন শেষে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৫টিতে। অর্থাৎ ১২ কার্যদিবসের ব্যবধানে শেয়ার আছে এমন বিও হিসাব কমেছে ২৪ হাজারের বেশি।
বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বাজারে হঠাৎ করেই কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অর্থের প্রবাহও কিছুটা কমে গেছে। গত কয়েক দিনের পতনে শেয়ারের দামে বড় ধরনের সংশোধন হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে নতুন করে আরও পতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করতে নানামুখী চেষ্টা চালাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পাশাপাশি বাজারে গুজব ছড়িয়ে কেউ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করছে কি না, সেটিও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে ঢাকার বাজারের গতকালের পতন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এদিন লেনদেন হওয়া ৩৭৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৭টির দাম বেড়েছে। আর বাছবিচার ছাড়াই ৩৬৪টি বা ৯৬ শতাংশেরই দাম পড়ে গেছে। এর মধ্যে লাফার্জহোলসিম, গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মার মতো বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামও বেশ কমে গেছে। সূচকে যা বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে বা তৈরি করা হয়েছে। তা না হলে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এ দেশের শেয়ারবাজারের এমন পতন হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তিনি এ–ও মনে করেন, বাজার যখন ৪ হাজার পয়েন্ট থেকে একটানা বেড়ে ৭ হাজারে উঠে গিয়েছিল, সেটিরও যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল না। কারসাজির মাধ্যমে অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের মনে সব সময়ই শঙ্কা ছিল, যেকোনো সময় পতন হতে পারে। এ জন্য যখন মন্দাভাব দেখা দিল, তখন এ আতঙ্ক আরও বেড়েছে। সেটিকে হয়তো কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বাজারে তদারকি বাড়ানো।
বিএসডি/ এমআর