নিজস্ব প্রতিবেদক:
তারপরও জীবদ্দশাতেই আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ দেখতে হয় নর্মানকে। এতে তাঁর চিন্তাভাবনারও খানিকটা পরিবর্তন এসেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন জার্মানির ফ্যাসিজম নিয়ে, আর যুদ্ধ শেষ হতে তিনি চিন্তিত হন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্রের উত্থান নিয়ে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পশ্চিমা দেশগুলো একটি সামরিক জোট গঠন করতে চাইল, তিনি তাতে প্রবল সমর্থন জানালেন। ১৯৪৯ সালে তৈরি হলো নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো। নর্মান এর পক্ষে গেলেন, কারণ তিনি ঐক্যবদ্ধ নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে ছিলেন।
নর্মান অ্যাঞ্জেল মারা গেছেন ১৯৬৭ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। এখন রাশিয়া একটি পৃথক রাষ্ট্র। নেই ন্যাটোর পাল্টা হিসেবে সোভিয়েতপন্থীদের ওয়ারশ চুক্তি। আবার তিনি যেমনটা মনে করেছিলেন যে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে না বলে যুদ্ধ জড়ানো ঠিক হবে না, তা-ও পুরোপুরি সঠিক হয়নি। ইরাক যুদ্ধ কতটা সামরিক প্রয়োজনে আর কতটা তেলের অধিকার বাড়াতে, সে প্রশ্ন তো আছেই।
দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তির অবস্থানটি ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই জায়গায় চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে চীন। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া এখন আর বড় অর্থনৈতিক শক্তি নয়। তবে বড় সামরিক শক্তি। ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করার পরে এখন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। যে ন্যাটোকে সমর্থন দিয়েছিলেন নর্মান অ্যাঞ্জেল, সেই ন্যাটোও রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বড় কারণ।
বড় শক্তি না হলেও অর্থনীতিতে অবশ্য রাশিয়ার একটি বড় রক্ষাকবচ আছে। আর তা হলো জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। ইউরোপ নির্ভর করে আছে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর। সুতরাং যুদ্ধ না করার পেছনে অর্থনীতিতে যে পারস্পরিক নির্ভরতার কথা নর্মান অ্যাঞ্জেল বলেছিলেন, তা আছে রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে। এ ছাড়া খাদ্যশস্যেও বড় শক্তি রাশিয়া ও ইউক্রেন। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, ইউক্রেন হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ সূর্যমুখী তেলের উৎপাদক, রাশিয়া আছে দ্বিতীয় স্থানে। এই দুই দেশ মিলে বিশ্বের মোট সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে। আবার বিশ্বের মোট গমের ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ উৎপাদিত হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনে। ইউরোপের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৯ শতাংশই জৈব জ্বালানিভিত্তিক, যা আসে মূলত রাশিয়া থেকেই।
যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইউক্রেন পণ্য রপ্তানি করতে পারছে না, আর রাশিয়াকে রপ্তানি করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে একঘরে করার নীতি সফল হলেও এতে বিপদে পড়বে বাকি বিশ্ব। রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস না পেলে মহাবিপদে পড়বে ইউরোপ। আর গম না এলে বিপদে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশ। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ যে মহা বিপর্যয়কর, তা বেশ জোরেশোরেই বলছে বিশ্বব্যাংক।
বিবিসির একটি লেখার শুরুটা এ রকম—‘এটা একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আপনি একদম সামনের সারিতেই আছেন। এই যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনীয়দের জন্য নয়, যারা বোমা ও গুলির মুখোমুখি। এই যুদ্ধ প্রত্যেকের জন্যই, কেননা প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক যুদ্ধের পরিণতি ভোগ করে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র হচ্ছে মূল্যস্ফীতি।’
ইউক্রেনের যুদ্ধ তাহলে কি করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল? ঠাট্টা করেই হয়তো এক লাইনের এই কৌতুকটা বলা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা এটাই। কৌতুকটা হচ্ছে, ‘ডিউ টু কোভিড-১৯, ন্যাটো অ্যান্ড ইউএসএ হ্যাভ ডিসাইডেড টু ফাইট ফ্রম হোম’। অর্থাৎ, কোভিড-১৯-এর কারণে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র বাসা থেকেই যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক যুদ্ধের পরিবর্তে যার যার দেশে বসেই যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে, তাতে বিপর্যয়ের মধ্যেই পড়ছে সারা বিশ্ব।
যুদ্ধে কিন্তু সাময়িকভাবে হলেও প্রবৃদ্ধি বাড়ে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়, চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তবে শর্ত আছে। আর তা হলো যুদ্ধটা করতে হবে অন্য এক দেশে। যেমন, একসময় যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করেছে ভিয়েতনাম বা ইরাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছিল আফগানিস্তানে। তবে এবারের যুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবেই যেকোনো যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ সময়টায় মূলত ধ্বংসের জন্যই অর্থ ব্যয় হয়, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
যুদ্ধ মানেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশ। যুদ্ধের প্রভাবে বাড়ছে তেলের দাম, যা মূল্যম্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। আবার খাবার তেলের দামও আকাশ ছুঁতে চলেছে। বাড়ছে সব ধরনের মেটালের দাম। এতে উৎপাদন খরচও বাড়ছে আরেক দফা।
২০২০ সাল থেকেই অনিশ্চয়তা অর্থনীতির অনুষঙ্গ হয়ে আছে। অনিশ্চয়তা অর্থনীতির বড় শত্রু। যুদ্ধ সেই অনিশ্চয়তা নতুন করে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে যুদ্ধ অর্থনীতির ওপর কত দূর পর্যন্ত প্রভাব ফেলবে, তা আরও জানা যাবে আগামী দিনগুলোতে।
বিএসডি/ এফএস