নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় বাবার মৃত্যুর এক মাস পর জন্ম হয় রায়নার। তার বয়স এখন ছয় বছর। রায়না মাঝেমধ্যেই পারিবারিক ছবির অ্যালবাম নিয়ে বাবাকে দেখে আর মাকে বলে, ‘আম্মু, বাবা কোথায়? বাবা আমার জন্য খেলনা আনবে না? আমি বাবার কাছে যাব…। ’
গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে এভাবেই বলছিলেন শিশু রায়নার চাচা মো. শামসুজ্জামান শামস।
তিনি বলেন, ‘কর্তব্যের টানে নিজের জীবন বিপন্ন করে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে ছুটে গিয়েছিলেন আমার ভাই ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। ’
হলি আর্টিজানে হামলার খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন রবিউল। জঙ্গিদের ছোড়া বোমায় নিহত রবিউল করিমের স্ত্রী উম্মে সালমা তখন সন্তানসম্ভাবনা ছিলেন। রবিউলের মৃত্যুর পর জন্ম নেওয়া সেই শিশুর নাম রাখা হয়েছে কামরুন্নাহার রায়না। রবিউলের বড় ছেলে ১২ বছরের সাজেদুল করিম সামি এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। দুই ভাই-বোনের বোবা দৃষ্টি সবার অলক্ষ্যে বাবাকে খোঁজে।
রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন পিতৃহীন সামি ও রায়নার কথা বলতে গিয়ে। তিনি বলেন, ‘ভাই বেঁচে নেই। ভাবি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভাইয়ের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। মানিকগঞ্জের গ্রামে ‘ব্লুমস কাটিগ্রাম’ নামের একটি প্রতিবন্ধী স্কুল ভাই থাকতেই প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। এই স্কুলে বর্তমানে ৬৯ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আছে। এই দরিদ্র শিশুদের দেখভাল করছি আমরা। তবে ভাইয়ের বন্ধু সার্কেল অর্থ দিয়ে স্কুলটি এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করছেন। ’
তিনি বলেন, ‘গতকাল বিকেলে ভাইয়ের দুই সন্তান, ভাবি ও আমি হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ছয় বছর উপলক্ষে রাজধানীর গুলশানে ‘দীপ্ত শপথ’ ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যাই। এ ছাড়া সকালে এলাকায় প্রতিবাদ ও স্মরণ র্যালি, মিলাদ মাহফিলসহ বিভিন্ন শোকসভার আয়োজন করি। ’
বনানী থানার সেই সময়ের ওসি সালাউদ্দিন খান। হামলার খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে নিহত হন তিনিও। তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা এই দিনে সমাজসেবামূলক কাজ করেন। সালাউদ্দিনের মেয়ে সামান্তা মায়ের কাছে বারবার বাবার কথা জানতে চায়। জবাব দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা রেমকিম খান। রেমকিমের বোন আইরিন বলেন, ‘দিনটি বরাবরই আমার বোন ও তার সন্তানদের কাঁদায়। পরিবারের সবাই দিনটিকে আলাদাভাবে স্মরণ করি। ’
হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ছয় বছর পূর্তিতে গুলশানের দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সালাউদ্দিনের স্ত্রী রেমকিম খান, মেয়ে সামান্তা খান ও ছেলে এস এম রায়ান।
এ সময় ওসি সালাউদ্দিনের স্ত্রী রেমকিম খান বলেন, ‘বাচ্চারা প্রতিটি দিন বাবাকে মিস করে, শুধু এই দিনে আমরা তাকে বেশি মিস করি, বিষয়টি এমন নয়। যেদিন থেকে আমরা ওকে (সালাউদ্দিন) হারিয়েছি, সেদিন থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে আমরা তাকে মিস করি। ’
দুই সন্তানের প্রসঙ্গ টেনে রেমকিম খান বলেন, ‘এমন কোনো দিন আমি দেখিনি, যেদিন সন্তানরা বাবাকে মিস করেনি। বাবার অনুপস্থিতিতে সন্তানরা কিভাবে যে বেড়ে উঠছে, বাবার জায়গাটি আমি মা হয়ে শত চেষ্টা করেও পূরণ করতে পারিনি। ’
দুই সন্তানের লেখাপড়া প্রসঙ্গে রেমকিম বলেন, ‘সে যখন মারা যায়, তখন মেয়েটি সপ্তম শ্রেণিতে আর ছেলেটি কেজি টুতে পড়ত। এখন মেয়েটি দেশের বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর ছেলে ঢাকার একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। ’
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলার ছয় বছর পূর্তি ছিল গতকাল শুক্রবার। ওই হামলায় জঙ্গিরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে ২০ দেশি-বিদেশি নাগরিককে। সেই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি।
বিএসডি/ফয়াসাল