শরীফ উল্যাহ
প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লম্বা সময় অনেক যানবাহন আটক করি। জিজ্ঞাসাবাদ করি, কী কারণে লকডাউন অমান্য করে বের হয়েছেন। অনেক মজার মজার জবাব পাই। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের প্রয়োজনটা সত্যিকার অর্থেই জরুরি। এদেরকে থামানো যায় না। এরা অদম্য। এরা ছুটে চলবেই। কারণ, প্রয়োজনটা এদেরকে অতি বেশি তাড়া দেয়! লকডাউন অমান্য করার কারণে এদেরকে জরিমানা করলেও এরা তাৎক্ষণিক দিতে প্রস্তুত।
অনেকেই আবার ভিন্ন চিন্তা-ভাবনার মানুষ। ছল-চাতুরী আর তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে এরা অনেক বেশি ওস্তাদ! রাস্তায় ধরা পড়লে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়েই তারা বের হন। অনেকেই ইদানীং ডাক্তারের পুরোনো প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হন। কেউ কেউ হাতে বা পায়ে ব্যান্ডিজ করে বের হন। কেউ সাথে ঔষধ নিয়ে বের হচ্ছেন। কেউ ছোট বাচ্চা, স্ত্রী, মা-বাবা কিংবা আত্মীয়-স্বজনের গুরুতর অসুস্থতার দোহাই দিচ্ছেন। কেউ জানাজা পড়তে যাবেন। কারও রিক্সায় চড়ার টাকা নেই! কিন্তু মোটর সাইকেল নিয়ে বের হয়েছেন! কেউ আবার অতি প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে অনেক দূরের পথ রিকশায় যেতে পারবেন না বলে মোটর সাইকেলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার অনেক বড় মিথ্যা বলেও পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। গাড়িতে নানান ধরনের স্টিকার লাগিয়ে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আমরা যারা মাঠে থাকি, আমরাও অনেক ক্ষেত্রেই উপলব্ধি করতে পারি যে, কার প্রয়োজনটা আসলেই অতি জরুরি। আবার কে বা কারা সামান্য প্রয়োজনে কিংবা প্রয়োজন ছাড়াই মোটর সাইকেল, সিএনজি বা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে, একটু ভালোভাবে যাচাই করলেই অনেকেই আমাদের কাছে ধরা পড়ে যান এবং শাস্তির সম্মুখীন হন। সেদিন একজন মোটর সাইকেল আরোহী জানালেন, তার এক আত্মীয় মারা গেছেন। তিনি এখন সেখানে যাচ্ছেন। তার যাওয়াটা অতি জরুরি। তাকে সন্দেহ হওয়াতে বললাম, আপনি কাউকে ফোন করেন আমরা কথা বলে দেখি। পরে সে বললো, আমি যাকে ফোন করতে চাচ্ছি তার মোবাইলে কল ঢুকছে না। আমি বললাম, আপনি অন্য কাউকে কল করেন, আমরা যাতে নিশ্চিত হতে পারি যে, আপনার আত্মীয় মারা গেছেন। প্রথম দিকে সে ফোন করতে না চাইলেও পরে আমাদের পীড়াপীড়িতে সে তার মাকে ফোন করেছে। কিন্তু তার মায়ের সাথে কথা বলে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! তার মা জানালো, কেউ মারা যায়নি। ছেলেটি তার খালাতো বোনের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছে।
কঠোর লকডাউনের মধ্যেই কিছু মানুষ প্রাইভেট কার নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে নানান অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করে থাকেন। কারও প্রয়োজনটা মানবিক কারণে বা অন্য কোন বৈধ কারণেই মেনে নেওয়ার মতো আবার কারোটা একেবারেই মেনে নেওয়ার মতো না। একটা শ্রেণি আইনের প্রতি মোটেও শ্রদ্ধাশীল নয়। এরা আইন লংঘন করেই মনে হয় আনন্দ পায়। সরকারের নির্দেশনা এদের কাছে তেমন কিছুই না। এরা নিজেদের মতো চলতে পছন্দ করেন। এদের অনেকেই দেশের প্রচলিত আইন বা সরকারের নির্দেশনা যে মানতে হয় এটা বুঝেও না বুঝার ভান করেন কিংবা ইচ্ছা করেই আইন অমান্য করেন।
অনেকেই এখনো মাস্ক ব্যবহার না করেই রাস্তায় বের হচ্ছেন, গাড়িতে চড়ছেন, দোকানে যাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। অনেককে দেখছি, লকডাউন অমান্য করে মোটর সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছেন কিন্তু তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, হেলমেট নেই, আবার দুই বা তিনজন নিয়েও গায়ে বাতাস লাগানোর জন্য বের হচ্ছেন। এখানে-ওখানে ঘুরতে যাচ্ছেন। এদেরকে ধরার পর বেশির ভাগেরই জবাব দেওয়ার কিছুই থাকে না। তখন উপস্থিত নানান অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করেন।
আসলে আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা অতি প্রয়োজন ছাড়া এভাবে আইন অমান্য করছেন বা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করছেন তারা কি করোনার বর্তমান পরিস্থিতি দেখছেন না? বিশ্বে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত বা মৃত্যুর খবর কি তারা রাখছেন না। বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের লাগামহীন গতি তাদের মনে একটুও ভয়ের সঞ্চার করছে না? করোনায় আক্রান্ত হয়ে অনেক পরিবারের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়।
বর্তমানে আমার বা আপনার আশেপাশেই করোনা রোগী হেঁটে বেড়াচ্ছেন! আমার-আপনার পাশের বাসাতেই করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির বসবাস! অনেকেই মুমূর্ষু প্রিয়জন নিয়ে দিশেহারা। অনেক পরিবার ইতোমধ্যে আপনজন হারিয়ে শোকস্তব্ধ। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই যে অভ্যাসটা সহজাত সেটি হচ্ছে, অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি না পেলে কিংবা অসুখ শরীরে বাসা না বাঁধলে কেউ ডাক্তারের কাছে যায় না। বিপদের আশংকা থাকলেও ভয় পায় না। তবে বিপদে পড়লেই অস্থির হয়ে যায়। আল্লাহকে ডাকতে থাকে। অনেক বিষয়েই আগে থেকে সচেতন হয় না। জোর করে কিংবা পিটিয়েও সচেতন করা যায় না। বোধ করি, জাতি হিসেবে আমাদের মনঃস্তত্ত্বটা খুবই অদ্ভুত।
আমরা হুজুগে চলি বেশি। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক রাস্তায় না হেঁটে ভুল রাস্তায় হাঁটতে পছন্দ করি। আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থ আর বৃহৎ স্বার্থের পার্থক্য বুঝতে চাই না। ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের তাৎপর্য বুঝি না। অনেক মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজন বা অপ্রয়োজন সঠিকভাবে বুঝতে চান না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় উপলব্ধি করতে চান না। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে! আমাদেরকে একটা মহা দুর্যোগের মধ্যে পড়তে হতে পারে! এই মুহূর্তে করোনা মোকাবিলায় যার যার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
সারাদেশে করোনা প্রতিরোধে সরকারের সকল উদ্যোগ, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল কার্যক্রম, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, মাইকিংসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা ও সর্বোপরি লকডাউনের ফলাফল তখনই ইতিবাচক হবে যখন জনগণ তাদের করণীয় বুঝতে পারবেন এবং সঠিকভাবে সাড়া দিবেন। বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব থেকে করোনা অচিরেই বিদায় নিক, আমাদেরকে মুক্তি দিক, সেই কামনা করি।
লেখক- শরীফ উল্যাহ
সহকারী কমিশনার (ভূমি) , হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।