শহরজুড়ে প্রবল বৃষ্টির সকালে ভেসে এল যেন শারদীয় হাওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের প্রকৃতি নিয়ে লেখা গানের সুরে সুরে ছায়ানটের প্রাঙ্গণজুড়ে ছড়িয়ে গেল বিভাবরী পোহানোর বার্তা। ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মেলক পরিবেশনার প্রথম গানটি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্বের ‘পোহালো পোহালো বিভাবরী,/ পূর্বতোরণে শুনি বাঁশরি’ গানটি। আকাশি শাড়ি আর সাদা পাঞ্জাবিতে নিজেদের শরতের রঙে সাজিয়ে নিয়ে শিল্পীরা শোনালেন ‘শারদ সুন্দরী’ নেমে আসার খবর।
শুক্রবার সকালে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ছায়ানটের শরতের অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল একক ও সম্মেলক গান, পাঠ আর দলীয় নৃত্য নিয়ে ১৭টি পরিবেশনায়। সবই ছিল প্রকৃতি আর রাগনির্ভর। নগরের মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে আরও একটু নিবিড় করে তুলতেই ছায়ানটের এই প্রয়াস। আয়োজকেরা জানান, প্রতিবছর চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় উন্মুক্ত পরিসরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে, ডেঙ্গু পরিস্থিতির জন্য অনুষ্ঠিত হলো ছায়ানট মিলনায়তনে। সকাল আটটায় শুরু হয় দেড় ঘণ্টার শরৎ অনুষ্ঠান।
ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা বললেন, শরতের যে আমেজ আছে, আছে প্রাণের আনন্দ, তা–ই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন শিল্পীরা। ঋতুভেদে আমাদের যে চর্চা, তাকেই আমরা উদ্যাপন করি এই সুর, সংগীত ও শব্দ দিয়ে। এতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন হয়।’
বৃষ্টিস্নাত সকালে ছায়ানটের আয়োজনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভৈরবী রাগের গান পরিবেশনার পরই ছিল ঘুম ভাঙানোর গান। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘জাগো জাগো প্রিয় রজনী পোহায়’ পরিবেশন করলেন শিল্পী সুস্মিতা দেবনাথ। ত্রিতালের গানটির পর শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে,/ নীল আকাশের ঘুম ছুটালে’ গানের সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য-গীত। এ গানের বাণীর মতোই ললিত রাগের সুর ঝরে পড়ল যেন শিউলিতলে।
নৃত্যশিল্পীরা নিজেদের গায়ে জড়িয়ে এলেন সবুজ রং। এরপর কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভোরে ঝিলের জলে’ পরিবেশনার পর শুরু হলো তাঁরই লেখা, ‘এসো শারদপ্রাতের পথিক’ গানটি। এ গানের শেষ বাণীতে ‘দূর নন্দন-তীর হতে ধরণিরে ভালোবেসে’ আসার আহ্বান জানালেন শিল্পী। ধরণিকে ভালোবাসা মানেই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠতা। সেই ভালোবাসা ছড়িয়েছে যন্ত্রসংগীতশিল্পীদের বাজনাতেও।
সুবীর সরকার ও গৌতম সরকারের তবলার তাল ঘুরেফিরে শ্রোতাকে কখনো আনন্দে, কখনো মৌনতায় মগ্ন করেছে। তেমনি মো. মনিরুজ্জামানের বাঁশির সুরে নিমগ্ন হয়েছে শ্রোতার হৃদয়। মন্দিরা বাজিয়েছেন প্রদীপ কুমার রায়। এসরাজে ছিলেন অসিত বিশ্বাস।
বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ভাদ্র ও আশ্বিন মাস শরৎকাল। এই ঋতুতে গরমের আধিক্য অথবা শীতের প্রকোপ কোনোটিই ততটা চড়া থাকে না। তাই ষড়্ঋতুচক্রে সবচেয়ে অনুকূল এই শরৎ। বাঙালির অন্যতম প্রিয় এই ঋতুর প্রতীক হিসেবে আসে কাশফুল আর শিউলি। ছায়ানটের শিল্পীদের সংগীতেও বারবার এসেছে সেই শিউলি ফুলের কথা। আশ্বিনের বৃষ্টির ভেতরও সে ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে শ্রোতার মনে।
শেষ দিকে কিশোর শিল্পী সায়ন ভৌমিক পাঠ করলেন, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ থেকে। এর পরই শুরু হলো এ গানের সঙ্গে নৃত্য। রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতের পাশাপাশি গাওয়া হলো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অতনু চক্রবর্তীর রচিত গান। অনুষ্ঠান শেষ হয় জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। শরতের স্নিগ্ধতা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে তখন শ্রোতারা ছিলেন বিভোর।
বিএসডি/এসএস