জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা হবে আত্মঘাতী
বিশেষ প্রতিনিধি,
নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যেই পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীতে বসছে পশুর হাট। এরই মধ্যে রাজধানীতে হাট বসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভক্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ৯টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ১১টি হাট বসানো হবে।
এদিকে সারা দেশ থেকে ব্যাবসায়ীরা ঢাকায় পশু নিয়ে আসতে শুরু করেছেন। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি দ্রত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঢাকায় যখন কোভিড সংক্রমণ তুঙ্গে ছিল, তখন গত ঈদে সরকারের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার হিড়িক পড়েছিল মানুষের। তাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া কোভিডের ঝুঁকি গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে; ক্ষতির মাশুল দিচ্ছে তাদের পরিবার-পরিজন। এখন কোরবানি উপলক্ষে পশু নিয়ে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা ঢুকবেন। তাদের মাধ্যমে চলমান ঢাকার কোভিডের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে গ্রামের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে।
ঢাকার দুই সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা বলছেন, হাট বসানোর সিদ্ধান্ত থাকলেও এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। অনুকুল পরিবেশ না পেলে শেষ মুহূর্তে এসে হাট বাতিল করা হবে। এখনো হাট বসানোর সময় শুরু হয়নি বলে জানান তারা। তবে এরই মধ্যে রাজধানীর কোথাও কোথাও হাট বসেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এমনই একটি হাট রাজধানীর ৪৫ নম্বর আওতাধীন ধূপখোলা মাঠে। আর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি সিদ্ধান্ত নিলেও এ নিয়ে আজ আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে; সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকার কোরবানির পশু অনলাইনে বেচাকেনার বিষয়ে এবারও উৎসাহিত করছে বলে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান।
জনস্বাস্থ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিডের এই পরিস্থিতিতে মহানগরীতে পশুর হাট বসতে দেওয়ার সিদ্ধান্তহবে আত্মঘাতী। কোভিড পরীক্ষা করে ও নেগেটিভ সনদ নিয়ে রাজধানীতে বাইরের ব্যাবসায়ীদের ঢুকতে দেওয়ার উদ্যোগটি সঠিক হবে না। কারণ সবাই এত ব্যাস্ত থাকবে যে সেটা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন
সম্ভব হবে না।
তবে পশুর হাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত যারা তারা বলছেন, হাটের প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে, শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা, ঠাণ্ডা, কাশি থাকলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতও উপস্থিতি থাকবেন হাটগুলোতে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম
বলেন, রাজধানীর দুই সিটিতে যে সীমিতসংখক পশুর হাট বসবে এরই মধ্যে নেওয়া সিদ্ধান্তটি বহাল আছে। এই হাটে বেচাকেনা চলবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। তবে বর্তমান কোভিড পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আগামী ১৩ জুলাই একটা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করব, সেখানে আলোচনা হবে কোভিডে হাট বসানো সমীচীন হবে কি না। এর পরও প্রধানমন্ত্রী কী নির্দেশনা দেন সেটি আমরা অনুসরণ করব। তবে অনলাইনে পশুর হাট এরই মধ্যে আমরা উদ্বোধন করেছি। মানুষদের এই ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পশু কেনার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি। এতে কোভিডের ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন এবং ঘরে বসেই পশু কিনতে পারবেন। তবে এর বাইরে যদি হাট বসাতে হয় তাহলে স্বাস্থ বিধি শতভাগ মানতে হবে। এদিকে ঢাকার দুই সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তরের সেলিম রেজা ও দক্ষিণের ফরিদ আহাম্মদ দুজনই এ বিষয়ে অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিদিনের সংবাদকে তারা বলেছেন, কোভিড সংক্রমণের
বিষয়টি পশুর হাট বসবে কী বসবে না এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই কোভিড সংক্রমণ আরো বাড়লে শেষ পর্যন্ত হাট বসানো যাবে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। তারা বলেন, ‘আরো সময় আছে আমরা অবস্থা বুঝে ব্যাবস্থা নেব।’ তারা আরো বলেন, পশুর হাট চালু রাখার উদ্যোগ নিচ্ছি, তবে শেষ পর্যন্ত পারব কি না
জানি না। তবে রাজধানীতে হাট বসার বিষয়টি তারা জানেন না বলে জানান। একই মন্তব্যা করেছেন গেণ্ডারিয়া থানার ওসি সাজু মিয়া। তিনি বলেছেন, তার
অধীনস্থ এলাকায় পশুর হাট বসেছে কি না এ মুহূর্তে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। আর ধূপখোলা মাঠে পশুর হাট বসার বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জেনেছি। এ বিষয়ে তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান। হেলথ অ্যান্ড হোফ কেয়ার হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও জনস্বাস্থ্যা বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন,
কোভিড সংক্রমণের মধ্যে যদি একান্তই হাট বসাতে হয়, তাহলে রাজধানীর কাছাকাছি অর্থাৎ খোলা ও উন্মুক্ত স্থান টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা কেন্দ্রে বসানো যায়। এ ক্ষেত্রেও হাটের প্রবেশ মুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা, শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা পরীক্ষা করা এবং -কাশি থাকলে প্রবেশ করতে না দেওয়া নিশ্চিত
করতে হবে। সার্বক্ষণিক তদারকিতে থাকতে হবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতি।
তিনি বলেন, কোভিড সংক্রমণে গত ১৬ মাসের মধ্যে এখন মৃত্যু ও শনাক্তের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আগে শহরকেন্দ্রিক সংক্রমণ বেশি থাকলেও বর্তমানে গ্রামেও ঊর্ধ্বমুখী। চলমান এই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি না কমলে ঈদ উৎসব কীভাবে পালন সম্ভব হবে এটাই ভাবার বিষয়। কাজেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোর
ভেতরে হাট বসানোর সিদ্ধান্ত অনেকটাই আত্মঘাতী এবং শহরের ভেতরে হাটের বিষয়টি নিয়ে বহুবার ভাবা
উচিত। এমনকি গ্রামেও খোলামেলা জায়গায় হাট হলে ধর্মীয় বিষয়টি ঠিক রেখে সংক্রমণের ঝুঁকিও কমানো যায়।
জনস্বাস্থ্যা এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, যেখানেই হাট বসানো হোক সেখানে ১৮-এর নিচে এবং ৫০-এর বেশি বয়সিকে যেতে নিরুৎসাহিত করতে হবে। তা ছাড়া যারাই যাবেন তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে শতভাগ। পশুর হাটে বিভিন্ন গ্রাম, জেলা শহর থেকে আসা ব্যাপারী, খামারিদের রাজধানীতে প্রবেশের আগেই
কোভিড টেস্ট করে হাটে আসাসহ, ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হাট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সবার করোনা স্যাম্পল টেস্ট ও নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক করা গেলে ঝুকি কমবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. লেলিন বলেন, হাটে এত বেশি মানুষের সমাগম হয় যে শুধু করোনা নেগেটিভ থাকলেই হবে না; সঙ্গে
আরটিপিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে। আসল কথা, হাট যদি বসাতেই হয় সেটা হতে হবে শহরের বাইরে
অবশ্যই খোলা বড় জায়গায়; হোক সেটা গ্রামে বা শহরে। ডা. লেলিন আরো বলেন, কোরবানি করা ওয়াজিব, ফরজ নয়। গত বছর অতিমারির কারণে পবিত্র হজ কিন্তু সীমিত আকারে কমসংখ্যক দেশ ও মানুষের সমাগমে পালন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে দেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় ও আলেম-ওলামাদের কাছ থেকেও মতামত নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বিএসডি/এমএম