অবসর নেওয়ার তিন বছরের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে পারবেন না বলে মাননীয় হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সেটি সময়োপযোগী। আমরা এ রায়কে স্বাগত জানাই।
অবসরের তিন বছর পার না হওয়া পর্যন্ত সামরিক-বেসামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার বিধান কেন অবৈধ হবে না, এ-সংক্রান্ত চারটি পৃথক রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
সোমবার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা অবসরের তিন বছরের মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
এ ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেছিলেন মো. শামীম কামাল, মো. আবদুল মান্নান, আতাউর রহমান প্রধান ও রতন চন্দ্র পণ্ডিত। রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, ভোটে অংশ নেওয়ার অধিকার সংবিধানের একটি মৌলিক বিষয়। সরকারি কর্মচারীদের অবসর বা পদত্যাগের পর সংসদ নির্বাচনে ভোটে দাঁড়াতে নিষেধ করা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের মূলনীতি ও সম-অধিকার উভয়ই লঙ্ঘন করে।
বর্তমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২ (১) (এফ) ধারা অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা অবসর নেওয়ার তিন বছরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। আরপিওর উল্লিখিত বিধান যৌক্তিক ও অবশ্যপালনীয়। অতীতে অনেক সরকারি কর্মকর্তা অবসর নেওয়ার পরপরই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, এমন অনেক উদাহরণ আছে।
এমনকি কোনো কোনো আমলা সরকারি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিজের নির্বাচনী এলাকায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে অন্যায্য প্রভাব সৃষ্টি করেছেন। একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মুখ্য সচিব থেকে পদত্যাগের কয়েক মাস পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়েছেন। আরেকজন আমলা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরদিনই মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এসব ঘটনা কেবল জনপ্রশাসন নয়, নির্বাচনী রাজনীতিতেও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাসগুপ্ত বলেছেন, ‘হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ হলো, সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণ নাগরিক নন এবং অবসর গ্রহণের পরপরই কার্যালয়গুলোয় তাঁদের প্রভাব থাকতে পারে।’ সরকারি কর্মকর্তারা যে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য প্রশাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে করে থাকেন, তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে।
এ কারণে আরপিওতে যখন তিন বছরের বিধান সংযুক্ত করা হয়, তখন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটি মেনে নেয়। আদালত যথার্থই বলেছেন, সাবেক আমলারা কেবল সাধারণ নাগরিক নন; অবসর নেওয়ার পরও প্রশাসনে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে।
কাকতালীয়ভাবে এমন সময়ে হাইকোর্ট রায়টি দিলেন, যখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। সেদিনই স্পষ্ট হবে সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কে কে প্রার্থী হচ্ছেন। অবসর নেওয়ার তিন বছর পর কোনো সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচন করলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এর কম হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
আদালতের নির্দেশ ও আরপিওর বিধান অগ্রাহ্য করে যাতে কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারেন, সেটা দেখতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই। ভয়ভীতিহীন পরিবেশে প্রতিনিধি বাছাইয়ের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। এখন যদি আরপিও মানার ব্যাপারেও তারা শৈথিল্য দেখায়, প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনটি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বিএসডি / এলএম