নিজস্ব প্রতিবেদক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্কুলছাত্র তাওহিদের শরীরে বিদ্ধ হয় ২২টি গুলি। এখনো তার শরীরে বহন করছে ৭টি গুলি। দেড় মাসেরও অধিক সময় ধরে শরীরে গুলি বহন করে চলেছে সে। চিকিৎসকরা অপারেশন করে তার শরীর হতে ১৫টি গুলি বের করে এনেছেন।
তাওহিদ মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। সে বালিগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র । তার বাবা মনির হোসেন পেশায় একজন কৃষক।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে টঙ্গিবাড়ী প্রেসক্লাবে জামায়াতে ইসলামির অর্থ সহায়তা নিতে এসে ঢাকা পোস্টের কাছে নিজেদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন তাওহিদ ও তার বাবা মনির হোসেন।
জানা যায়, তাওহিদ গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মুন্সীগঞ্জ সুপার মার্কেট এলাকায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ওই আন্দোলন চলাকালীন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ তাদের ওপর গুলি ছুড়লে তাওহিদের দু চোখ-কান কপাল মাথাসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে মোট ২২টি গুলিবিদ্ধ হয়। চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় দু-চোখে কোনো কিছুই দেখছিল না সে। চোখ দিয়ে ঝরছিল রক্ত। গুলি থেকে বাচঁতে চোখ বুজেই দেয় দৌড়। তাকে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে অন্যান্য আন্দোলনকারীরা নিয়ে যায় মুন্সীগঞ্জের গোয়লপাড়ায় নাসরিন বেগম নামের এক নারীর বাসায়। সে সময় হাসপাতাল এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে পুলিশ ও সরকার দলীয় লোকজনের হামলা চলছিল। তাই তাওহিদকে ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি। ওই বাড়িতেই মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল সে। বিনা চিকিৎসায় সারাদিন ও একরাত আতঙ্ক ভয়ে কাটে তার।
এদিকে ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পান তার বাবা মনির হোসেন। ছেলেকে দেখতে এসেও যানবাহন সংকটসহ নানা বাঁধার মুখে ওই সময় দেখতে পারেননি। আশ্রয়দাতা নাসরিন বেগম ভয়ে সে সময় তাওহিদের বাবাকে তার বাড়ির ঠিকানা দেননি। তাছাড়া বারণ করেছিলেন তার বাড়িতে আসতে। কারণ তিনি ওই সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অনেককেই বাড়িতে গোপনে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে আটক হতে পারেন পুলিশের হাতে সে ভয়ে তিনি বাড়িতে আসতে নিষেধ করেন তাওহিদের বাবাকে। ঠিকানা না পেয়ে তাওহিদের বাবা ছেলের আশ্রয়দাতার বাড়ির আশপাশের স্থান দিয়ে ঘুরে ফিরে বাড়ি চলে যান। বাড়িতে ফিরে দেখেন স্ত্রী তাওহিদের মা ছেলের শোকে হার্ট অ্যাটাক করেছেন মুখ বাঁকা হয়ে গেছে তার। একদিকে ছেলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অন্য বাড়িতে আশ্রয়ে অন্যদিকে স্ত্রীর হার্ট অ্যাটাকে কাতর হয়ে পড়েন মনির হোসেন।
তারপরেও যোগাযোগ রাখছিলেন ছেলের আশ্রয়দাতা নাসরিন বেগমের সাথে। পরে নাসরিন বেগম বলেন, ভোর রাত ৫টার দিকে সে গোপনে তাওহিদকে তুলে দেবেন তাদের হাতে। ছেলেকে পেতে আশ্রয়দাতার শর্ত অনুযায়ী ৫ আগস্ট ভোর রাত ৪টার দিকে তাওহিদের চাচিকে সঙ্গে নিয়ে তাওহিদের বাবা ছুটে যান আশ্রয়দাতার বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এক জায়গায়। পরে নাসরিন বেগম তাওহিদকে তুলে দেন তার বাবার হতে। ৫ আগস্ট ভোরে তাওহিদকে নিয়ে তার বাবা চলে আসেন বাড়িতে। সে সময় চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই বাড়িতেই রেখে দেন ছেলেকে। পরে ৬ আগস্ট দেখেন ছেলের পেটে বিদ্ধ গুলির স্থানগুলোতে পচন শুরু হয়েছে। মনির হোসেন নিজেই তাওহিদের পেটে চাপ দিয়ে বের করে আনেন ৪টি গুলি। পরে ৬ আগস্ট তারিখে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু ওই হাসপাতালে তাওহিদের শরীর হতে কোনো গুলি বের করেনি। পরে ১৬ আগস্ট তাকে নেওয়া হয় ঢাকাস্থ আগারগাঁওয়ের সেনাবাহিনী পরিচালিত সিএমএম হাসপাতালে। ওখানে নেওয়ার পরে ১৭ আগস্ট ৩টি, ২৪ আগস্ট ৪টি এভাবে মোট ১৫টি গুলি বের করা হয় তাওহিদের শরীর থেকে। এখনো তাওহিদের শরীরে ৭টি গুলি রয়েছে।
তাওহিদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য গত ৪ আগস্ট তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। মুন্সীগঞ্জ সদরের সুপার মার্কেট এলাকায় যাওয়ার পরে দেখি সেসময় অল্প কয়জন লোক হয়েছে। তখন পুলিশ কিছুতেই রাস্তায় আমাদের দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। পরে আমরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিলাম। বেলা বাড়ার সঙ্গে অনেক লোকজন আসতে থাকে। পরে আমরা মুন্সীগঞ্জ সুপার মার্কেট এলাকায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করতে থাকি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে আমার শরীরে মোট ২২টি গুলি লাগে। আমার দু-চোখেও গুলি লাগায় আমি চোখে কিছুই দেখছিলাম না। সে সময় অন্য আন্দোলনকারী বন্ধুরা আমাকে মুন্সীগঞ্জ শহরের গোয়লপাড়া গ্রামের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। ওখানে নাসরিন বেগম নামের এক মহিলা আমাদের অনেক অন্দোলনকারীদের আশ্রয় দেয়। ওই ভদ্র মহিলার স্বামী বিদেশে থাকেন। উনি আমাদের খুব কষ্টে বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। একদিকে শরীরে যন্ত্রণা অন্যদিকে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজনের ভয়ে চিকিৎসা ছাড়াই লুকিয়ে ছিলাম। পরে সকালে বাবা গিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে আমাকে। এসে দেখি মা হার্ট অ্যাটাক করেছে মুখ বাঁকা হয়ে আছে। পরে আমি বাবাকে বলি আমাকে বাইরে নিলে সমস্যা হতে পারে। আমার কিছু হবে না তুমি মাকে ডাক্তার দেখাও। বাবা-মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। পরেরদিন দুপুরে শুনি দেশ স্বাধীন হয়েছে আমরা মুক্ত হয়েছি। পরে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ও সিএমএম হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। আমার দু-চোখে কপালে ও মাথায় এখনও ৭টি গুলি আছে। মাঝে মধ্যেই খুব যন্ত্রণা হয়। আমার চিকিৎসা চলছে।
তাওহিদের বাবা মনির হোসেন বলেন, তাওহিদ আমাদের না বলেই আন্দোলনে গিয়েছিল। আমি বিষয়টি জানতাম না। গুলি লাগার পরে আমার ছোট ছেলে আমাকে বলে ভাইয়া আন্দোলনে গিয়ে গুলি খেয়েছে এক বাড়িতে আছে। আমি ছুটে যাই সেই বাড়ির কাছে। কিন্তু যে মহিলা ওকে আশ্রয় দিয়েছে সে আমাকে জানায় আপনি এখন বাড়িতে গেলে তার বিপদ হবে। পরে ৫ তারিখ ভোর ৫টার দিকে তাওহিদের চাচিকে সাথে নিয়ে ওই বাড়িতে গেলে ওই মহিলা তাওহিদকে আমার হাতে তুলে দেয়। তাওহিদ এখন সিএমএম হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ওর দুচোখে কপালে মাথায় এখনো ৭ গুলি রয়েছে। ডাক্তার বলছে একেক করে বের করবে।
তিনি আরও বলেন, ওর সব গুলি বের করতে যদি টাকা-পয়সা কম খরচ হয় তাহলে আমি বহন করতে পারব। আর টাকা বেশি লাগলে আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি কৃষক মানুষ।