নিজস্ব প্রতিবেদক
‘বাংলাদেশে তরুণদের সামাজিকভাবে উদ্যোক্তা হওয়া বেশ কঠিন’- গত ১৩ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটে ‘আমি জিততে চাই’ ক্যাম্পেইনে কথাটি বলেই থামলেন ফারহানা যুথী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আন্তর্জাতিক বিভাগের শিক্ষার্থী তিনি।
তার ভাষ্য, ‘একজন উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। ব্যবসা শুরু করার টাকা কোথায় পাব, লোন কে দেবে এগুলো তো রয়েছেই। তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিবারের সহযোগিতা। আমাদের পরিবারগুলো সবসময় সন্তানদের স্থায়ী চাকরি করতে বলে। প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় সংসারের দায়িত্বের কথা। সময়ের আগেই পরিবারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার কারণে তরুণরা উদ্যোক্তা হওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। তারা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকে পড়ে। আবার আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমলাই তৈরি করে। কোনো উদ্যোক্তা বা ক্রিয়েটিভ ব্যক্তি তৈরি করে না।’
চবি ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক এই প্রেসিডেন্ট জানান, কর্মক্ষেত্রের জন্য অনেকের প্রয়োজনীয় স্কিল থাকে না। আবার তথ্য ঘাটতিও রয়েছে। তথ্য না জানায় অনেক যোগ্য মানুষও সুযোগ পায় না। যুথী নিজেও চট্টগ্রাম শহরে বেড়ে উঠেছেন। নাগরিক হিসেবে অনেক সুযোগের কথা তিনি পরে জেনেছেন। তাহলে প্রান্তিক পর্যায়ে তথ্য ঘাটতি কেমন?
সত্যিটা হলো বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশন থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিল, উপজেলা প্রশাসন থেকে ইউনিয়ন-পৌরসভা পর্যন্ত তথ্য ঘাটতির সমস্যা প্রকট। কি স্কিল প্রয়োজন এবং যতটা সামর্থ্য আছে তা কতটুকু কাজে লাগবে তা জানেন না অনেকে। তথ্য ঘাটতি দূর করে এই সমস্যার সমাধান ও সমন্বয় করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
যুথী বলেন, ‘লক্ষ্য করলে দেখবেন, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়েন, তাদের জন্য কর্পোরেট জায়ান্টসদের লাইন লেগে থাকে। সবাই তাদের নিতে চায়। কিন্তু এটা সব বিভাগের ক্ষেত্রে হয় না। এই পলিসি বাকিদেরও নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাজুয়েটদের টার্গেট করে প্ল্যান সাজাতে পারে। আর যাদের জন্য সেভাবে কাজের সুযোগ নেই যেমন চারুকলার ক্ষেত্রে- তাদের ইনসেনটিভ দিতে হবে।’
বাংলাদেশের গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রতি বছর ২২ থেকে ২৪ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে। তাদের সবার পক্ষে সরকারি চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের দূরত্ব থাকায় যুব সমাজের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে তরুণদের অংশগ্রহণের পেছনে এই বিষয়টিও কাজ করেছে।
প্রায় একই মত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটির প্রেসিডেন্ট তন্ময় তাউসিফের। শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি বিভিন্ন নাগরিক অধিকার ও ইস্যু নিয়ে সম্পৃক্ত থাকেন।
তাউসিফের ভাষ্য, ‘এতদিন নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে তরুণদের কথা পৌঁছাত না। নীতি নির্ধারণে তাদের সমস্যাগুলো বিবেচনায় নেওয়া হত না। এখন দেশে পরিবর্তনের একটা সুযোগ এসেছে। পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলাচ্ছে।
ইউএসএইডের অর্থায়নে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের আয়োজনে ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেইন তারই উদাহরণ।’
কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী তাউসিফ বলেন, ‘আমি এখন একটু হলেও স্যাটিসফাইড যে কেউ একজন আমার কথা শুনছে বা আমি বলার সুযোগ পাচ্ছি। আমাদের পক্ষে খোলনলচে পাল্টে ইউরোপ বা জার্মানির মতো হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের ধাপে ধাপে এগোতে হবে। আমরা হয়ত দুর্নীতি একেবারে বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু কিছুটা হলেও লাগাম টানতে পারব।’
বাংলাদেশের নাগরিকরা যাতে তাদের জন্য থাকা সুযোগ-সুবিধাগুলো পায় এবং জানতে পারে তাদের জন্য কী আছে, কোনো শ্রেণিবৈষম্য যেন না থাকে এমনটাই চাওয়া তাউসিফের। তিনি মনে করেন, ‘খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। কিন্তু বাজার চাহিদার বিষয়ে তথ্য ঘাটতি থেকে গেছে। আরেকটা বড় সমস্যা হলো সিন্ডিকেট। এসব কারণে দেশের সাধারণ মানুষ স্বস্তি পায় না। বাজার মনিটরিং আরও কার্যকর করার পাশাপাশি ঢেলে সাজানো উচিত। অবশ্যই নীতি নির্ধারকদের নতুন
জনগণের কথা বিবেচনায় নিতে হবে, তাদের যুক্ত করতে হবে। নইলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার এই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারব না।’
এদিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদেরই একজন সাদিয়া আফরিন। চট্টগ্রাম কলেজের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি জানি না গ্রাজুয়েশন শেষে নিজের মতো করে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে কতটুকু সুযোগ পাব। জেলা বা বিভাগীয় শহরে কাজের সুযোগ খুব কম। আর থাকলেও কর্মপরিবেশ
নারীদের জন্য যথাযথ কিনা সংশয় রয়েছে। আমি মনে করি না, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে দারুণ ও সহানুভূতিশীল কর্মপরিবেশ তৈরি হয়েছে।’
সাদিয়া গণপরিবহনের সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। তার মতে, চট্টগ্রাম শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থায় কোনো নিয়ম নেই। শহরের গণপরিবহনে নারী ও শিশুরা অবহেলিত থাকেন। চালকরা যেকোনো স্থানে গাড়ি থামিয়ে তাদের ড্রপ করতে চান। টিকিট ব্যবস্থা চালু নেই। কখনো কখনো শারীরিক হেনস্তারও শিকার হতে হয়। গাড়ি ভাড়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অনেকসময় হাতাহাতিতে গড়ায়। তিনি চান, তারা যেন পুরো দেশেই নিরাপদ গণপরিবহন পান।
ইউএসএইডের স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল) প্রকল্পের আওতায় ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেইনে উপস্থিত হয়েছিলেন যুথী, তাউসিফ ও সাদিয়া। সেখানেই নিজেদের চাওয়া ও মতামত তুলে ধরেন তারা। তরুণ প্রজন্মের এই দাবিগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তারা যে সব সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে আমাদের সবার দাবিগুলোর কিছু মিল আছে, যা সুশাসন, জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।