নিজস্ব প্রতিবেদক,
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার ১০ দিন পর ১৮ মার্চ ২০২০ করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও ৫০৪ দিন। এই সময়ে করোনায় প্রাণহানি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৬ জনে। এরমধ্যে সর্বশেষ এক হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মাত্র ছয় দিন সময়ের মধ্যে। এই ছয় দিনে দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন এক হাজার ১৫২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে করোনায় মৃত্যু ১৮ হাজার ছাড়িয়েছিল ১৮ জুলাই। তার ঠিক ছয় দিনের মাথায় ২৪ জুলাই এসে সেই সংখ্যা ১৯ হাজার পেরিয়েছে। এর আগে ৯ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত মাত্র পাঁচ দিনে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যায় এক হাজারের অধিক।
যেভাবে ১৯ হাজার মৃত্যু
দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। প্রায় একমাস পর ১৫ এপ্রিল করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০-এর ঘরে পৌঁছায়।
১৫ দিনের মাথায় ১০ জুন এই সংখ্যা স্পর্শ করে হাজারের ঘর। সে হিসাবে দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের ৯৫ দিনে করোনায় মৃত্যু স্পর্শ করে হাজারের ঘর।
এর ২৫ দিনের মধ্যেই করোনায় আরও এক হাজার মৃত্যু হয়। ৫ জুলাই দুই হাজার ছাড়িয়ে যায় করোনায় মৃত্যু।
এরপরের এক হাজার মৃত্যু হয় আরও দ্রুত— মাত্র ২৩ দিনে। ২৮ জুলাই তিন হাজারের ঘর ছাড়িয়ে যায় করোনায় মৃত্য।
দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে চার এবং পাঁচ হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে সময় লাগে ২৮ দিন করে। ২৫ আগস্ট চার হাজার ও ২২ সেপ্টেম্বর পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায় মৃত্যু।
তারপর করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর গতি সামান্য কমে যায়।
২২ সেপ্টেম্বরের ৪৩ দিন পর ৪ নভেম্বর ছয় হাজার এবং এর ৩৮ দিন পর ১২ ডিসেম্বর সাত হাজার এবং তার ৪২ দিন পর ২৩ জানুয়ারি করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু পেরিয়ে যায় আট হাজারের ঘর।
এরপর করোনায় মৃত্যুর গতিতে লাগাম টানা সম্ভব হয়। আট হাজারের পর মৃত্যু ৯ হাজারের ঘরে যেতে সময় লাগে দুই মাসেরও বেশি— ৬৭ দিন। এ বছরের ৩১ মার্চ দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার পেরিয়ে যায়।
এপ্রিলে দেশে করোনায় মৃত্যু আগের সকল পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যায়।
এ মাসের এক দিনে ওই সময়কার সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যুও দেখেছে বাংলাদেশ। তাতে এপ্রিলের প্রথম ২৫ দিনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে দুই হাজার ৭ জনের মৃত্যু হয়। ২৫ এপ্রিল করোনায় মোট মৃত্যু ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর ১৬ দিন পরে অর্থাৎ ১১ মে মৃত্যু ছাড়ায় ১২ হাজারের ঘর।
১১ জুন দেশে করোনায় মৃত্যু ১৩ হাজার ছাড়ায়। এর পরের হাজার মৃত্যুতে সময় লাগে ১৫ দিন। ২৬ জুন দেশে করোনায় মৃত্যু ১৪ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর ঠিক আট দিন পরেই ৪ জুলাই দেশে করোনায় মৃত্যু ১৫ হাজারে পৌঁছায়। এই আট দিনের প্রতিদিনই করোনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
৪-৯ জুলাই পর্যন্ত ছয় দিনে দেশে এক হাজার ৯২ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে ৭ জুলাই প্রথমবারের মতন মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়ায়।
৯ জুলাই দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ২১২ জন মৃত্যুবরণ করেন।
১০-১৪ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে দেশে করোনায় এক হাজার ৪৮ জনের মৃত্যু হয়। এই পাঁচ দিনের চার দিনই দেশে ২০০র বেশি মানুষ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। তাদের মধ্যে ১১ জুলাই দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান ২৩০ জন।
১৪ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত দেশে এক হাজার ২৮৩ জন মারা যান কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে। এই ছয় দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়ায়।
২০ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে দেশে এক হাজার ১৫২ জন মৃত্যুবরণ করেন। ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৪৬ জন।
২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর ৫ দিন
১৯ জুলাই: কোভিড-১৯ সংক্রমিত ২৩১ জনের মৃত্যু, যা এখন পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড
১১ জুলাই: ২৩০ জনের মৃত্যু, যা ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু
১৫ জুলাই: ২২৬ জনের মৃত্যু, যা করোনা সংক্রমণ নিয়ে একদিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু
১৮ জুলাই: ২২৫ জনের মৃত্যু, যা করোনা সংক্রমণ নিয়ে ২৪ ঘণ্টায় চতুর্থ সর্বোচ্চ মৃত্যু
১২ জুলাই: ২২০ জনের মৃত্যু, যা করোনা সংক্রমণ নিয়ে একদিনে পঞ্চম সর্বোচ্চ মৃত্যু
এদিকে, দেশে এখন পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ৭৪ জন পুরুষ এবং পাঁচ হাজার ৯৭২ জন নারী করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন। শতাংশ হিসাবে করোনায় মোট মৃত ব্যক্তির ৬৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ পুরুষ, ৩১ দশমিক ৩৬ শতাংশ নারী।
বয়সভিত্তিক মৃত্যুর হিসাব
সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৯৫ জন করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ১ জনের বয়স ১০০ বছরের বেশি। ৯১ থেকে ১০০ বছর বয়সসীমার মধ্যে মারা গেছে ২ জন ও ৮১ থেকে ৯০ বছর বয়সসীমার মধ্যে মারা গেছে ১৬ জন। এছাড়াও ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সসীমায় ৩৪ জন ও ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সসীমায় মারা গেছে ৪৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতদের মধ্যে ৪৫ জনের বয়স ৫১-৬০ বছরের মধ্যে। এছাড়া, ৪১-৫০ বছর বয়সী ৩১ জন এবং ৩১-৪০ বছর বয়সী ১৬ জন মারা গেছেন। ১১-২০ বছর বয়সী দুই জন এবং ০-১০ বছর বয়সী এক জন মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণকারী ১৯ হাজার ৪৬ জনের মধ্যে ১০ হাজার ৫১৮ জনই ষাটোর্ধ্ব। অর্থাৎ, করোনায় মৃতদের ৫৫ দশমিক ২৩ শতাংশই এই বয়সী। আর, সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে নবজাতকসহ অনূর্ধ্ব-১০ বছর বয়সীদের।
এছাড়াও, ৫১-৬০ বছর বয়সী চার হাজার ৫৬৪ জন (২৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ) ও ৪১-৫০ বছর বয়সী দুই হাজার ২৮০ জন (১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ) মানুষ করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন।
অন্যদিকে, নবজাতক থেকে শুরু করে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে মারা গেছে ৫৬ জন (শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ), ১১-২০ বছর বয়সী মারা গেছে ১২৩ জন (শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ), ২১-৩০ বছর বয়সী ৪০৫ জন (২ দশমিক ১৩ শতাংশ) এবং ৩১-৪০ বছর বয়সী এক হাজার ১০০ জন (৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ) মারা গেছেন।
করোনায় বিভাগওয়ারি মৃত্যু
২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৬৮ জন মারা গেছে ঢাকা বিভাগে। ৩৬ জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। খুলনা বিভাগে মারা গেছেন ৪১ জন। রাজশাহী বিভাগে মারা গেছেন ১৮ জন। সিলেটে বিভাগে ১ ও বরিশাল বিভাগে ৫ জন মারা গেছেন। রংপুর বিভাগে ১৬ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জনের করোনায় মৃত্যু হয়েছে।
এখন পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ঢাকা বিভাগে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ে আট হাজার ৯৭৮ জন মারা গেছেন। যা মোট মৃত্যুর ৪৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৪৭২ জন জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগে মৃত্যুর হার মোট মৃত্যুর ১৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪৬৫ জন মারা গেছেন খুলনা বিভাগে। যা মোট মৃত্যুর ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
এর বাইরেও, রাজশাহী বিভাগে এক হাজার ৪৬৪ জন (সাত দশমিক ৬৯ শতাংশ), রংপুর বিভাগে ৯৩০ জন (চার দশমিক ৮৮ শতাংশ), সিলেট বিভাগে ৬৭২ জন (তিন দশমিক ৫৩ শতাংশ), বরিশাল বিভাগে ৫৮১ জন (তিন দশমিক ০৫ শতাংশ) ও ময়মনসিংহ বিভাগে মারা গেছেন ৪৮৪ জন (দুই দশমিক ৫৪ শতাংশ)।
এ পরিস্থিতিতে করণীয়
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় কী— জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যায় সম্প্রতি ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। তবে একই সময়ে কিন্তু সংক্রমণও অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, সংক্রমণ বাড়লেই বয়স্ক মানুষদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়বে। যারা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। আর বয়স্ক এবং এ ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে মৃত্যুর হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তাই, সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ডা. আলমগীর আরও বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে সবচেয়ে জরুরি হলো ব্যক্তির সচেতনতা। সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিয়ে বাস্তবায়ন করবে কিন্তু ব্যক্তি যদি সচেতন হয়ে সরকারি পদক্ষেপে সহযোগিতা না করে; তবে বিপদ বাড়বে।
কারণ, কোনো এলাকায় একজন সংক্রমিত হলেই তার পরিবার-সমাজে সংক্রমণ ছড়াবে। এ কারণেই সকলকে মাস্ক ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সচেতন থাকার পাশাপাশি, মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে এবং নমুনা পরীক্ষা করে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন আইইডিসিআরের এই কর্মকর্তা।
বিএসডি/এমএম