করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রথম পর্যায়ে ১৮ শ্রেণির ৫২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এর পর পর্যায়ক্রমে অন্যরা টিকা পাবেন। প্রথম পর্যায়ের তালিকায় আছেন স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সামরিক-আধা সামরিক বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা, সেবা সংস্থায় কর্মরত, ধর্মীয় পেশাজীবী, পোশাক শ্রমিক, বন্দরকর্মী ও রোগ প্রতিরোধ কম থাকা মানুষরা। জাতীয় কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনার প্রাথমিক খসড়ায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়াটি অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। করোনার টিকা দেশে আসার পর তা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংরক্ষণ করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, টিকা বিতরণ সংক্রান্ত খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী চার পর্যায়ে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। বাকি ২০ শতাংশকে হার্ড ইমিউনিটির (গণরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) কারণে টিকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
বিভিন্ন দেশে করোনা টিকা তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি টিকা ব্যবহারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এসব টিকা কোভেক্সের মাধ্যমে পাবে বাংলাদেশ। এ টিকা আসার দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। তবে অক্সফোর্ডের তৈরি ৩ কোটি টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার। আগামী মাসে এ টিকা দেশে আসার কথা। টিকা ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে জাতীয় পর্যায়ে ৩টি কমিটি হয়েছে।
করোনার টিকা দেশে আসার পর তা সংরক্ষণ, বিতরণসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ২০ অক্টোবর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে প্রধান উপদেষ্টা করে ২৬ সদস্যের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। হয়েছে জেলা-উপজেলা কমিটিও। এসব কমিটি করোনার টিকা আমদানি, সংরক্ষণ, পরিবহন, টিকা গ্রহণকারীদের তালিকা তৈরিসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করার কাজ করছে। ইতোমধ্যে টিকা কারা পাবেন, কোথা থেকে দেওয়া হবে, টিকা প্রদানের সময় সূচিসহ যাবতীয় বিষয়ের সমন্বয়ে একটি খসড়া প্রস্তুত করে তা অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজি) ডা. মারুফুর রহমান বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সাধারণত ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। সেই সেটআপ আমাদের আছে। আর কোভেক্সের মাধ্যমে যেসব টিকা আসবে সেটি এখনো নিশ্চিত করেনি। কোভেক্সের মাধ্যমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসার সম্ভাবনাই বেশি। যদি কোভেক্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজারের টিকা আসে সেটি মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং মডার্নার টিকা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হবে। সেই চিন্তা করে কী পরিমাণ কোল্ডস্টোরেজ লাগতে পারে সেগুলোর ইস্টিমেশন আমাদের করা আছে।
তিনি জানান, একেবারে প্রথম পর্যায়ে (‘এ’ গ্রুপ) প্রায় ৫২ লাখ মানুষকে (জনসংখ্যার ৩ শতাংশ) টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছেন সরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী, যার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। এর পর রয়েছে সব বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও এনজিওসহ সরাসরি কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, এর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। অগ্রাধিকারের তালিকায় আরও আছেন সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নন-কোভিড সেবায় নিয়োজিত ১ লাখ ২০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী।
একই ধাপে টিকা পাবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকা ২ লাখ ১০ হাজার বয়স্ক মানুষ। এ তালিকার পর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর (পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, আনসার, ভিডিপি) ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন, সামরিক-আধা সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট) প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ জন। এর পর রয়েছেন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা (মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, জেলা প্রশাসক, ইউএনও) প্রায় ৫ হাজার জন। সম্মুখসারির সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী প্রায় ৫০ হাজার। জনপ্রতিনিধি (সাংসদ, মেয়র, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, কাউন্সিলর) ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন।
সিটি করপোরেশনের প্রায় দেড় লাখ কর্মী। তালিকায় আরও আছেন ধর্মীয় পেশাজীবী (মসজিদ, মন্দির, চার্চ, বৌদ্ধমন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয় সংশ্লিষ্টরা) প্রায় ৫ লাখ ৮৬ হাজার জন এবং দাফন ও সৎকারে যুক্ত ৭৫ হাজার কর্মী। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছেন গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন, ফায়ার সার্ভিস ও পরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত প্রায় ৪ লাখ কর্মী, বন্দরকর্মী প্রায় দেড় লাখ, প্রবাসী শ্রমিক ১ লাখ ২০ হাজার, যারা কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে ফিরে যাবেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরাসরি মানুষের সংস্পর্শে কাজ করতে হয় এমন ৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন ব্যাংককর্মী। এ ছাড়া যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম (যেমন এইচআইভি, যক্ষ্মা, ক্যানসার ইত্যাদিতে আক্রান্ত) এমন সোয়া ৬ লাখ জনও তালিকায় রয়েছেন। আর বাফার রিজার্ভ হিসেবে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য প্রায় ৭৮ হাজার জনকে দেওয়ার মতো টিকা জমা রাখা হবে।
প্রথম পর্যায়ে (‘বি’ গ্রুপ) প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে (জনসংখ্যার ৭%) টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ তালিকায় অগ্রাধিকার পাবেন ৬০ বছর বেশি বয়সীরা। এ বয়সীদের করোনাজনিত মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
ডা. মারুফ জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ কোটি ৭২ লাখ মানুষকে (জনসংখ্যার ১১-২০%) টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ তালিকায় ৫৫ বছর বা তার বেশি বয়সী যারা প্রথম ধাপে টিকা পাননি এমন ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৭ জন রয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছেন বয়স্ক ও ঝুঁঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত ৩০ লাখ ২১ হাজার ৯৩৬ জন, সংক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩ জন, আগের ধাপে টিকা না পাওয়া গণমাধ্যমকর্মী ৫০ হাজার জন, দুর্গম এলাকার ১০ লাখ ১১ হাজার ২২৮ জন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ১২ লাখ, গণপরিবহনকর্মী ৫ লাখ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ফার্মেসিতে কর্মরত ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৬৪ জন এবং তৈরি পোশাককর্মী ৩৬ লাখ। এ ধাপে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে ৩ লাখ টিকা।
তৃতীয় পর্যায়ে টিকা পাবেন আরও প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ (জনসংখ্যার বাকি ২১-৪০%)। এ ধাপে অগ্রাধিকার পাবেন ৬ লাখ ৬৭ হাজার ২০৪ জন শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী- যারা আগের ধাপে টিকা পাননি। এ ছাড়া রয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা নারী, আগে টিকা না পাওয়া সরকারি কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মী, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী, রপ্তানি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মী, কয়েদি ও জেলকর্মী, বস্তিবাসী বা ভাসমান জনগোষ্ঠী, কৃষি ও খাদ্য সরবরাহে নিয়োজিত কর্মী, বিভিন্ন ডরমিটরি নিবাসী, গৃহহীন জনগোষ্ঠী, অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মী; অন্যান্য গণপরিবহনের কর্মী এবং ৫০-৫৪ বছর বয়সীরা। শেষ পর্যায়ে আরও ৬ কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ মানুষকে (জনসংখ্যার বাকি ৪১-৮০%) টিকা দেওয়া হবে। এ ধাপে শিশু, কিশোর, স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী ও অন্যরা থাকবে।
তালিকা হবে যেভাবে
টিকদানের প্রতিটি পর্যায়ে তালিকা তৈরি করবে জেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা কোভিড-১৯ সমন্বয় কমিটি। লক্ষ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছা নিবন্ধনের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মবিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্টের দিয়ে ইলেকট্রনিক সিস্টেমে নিবন্ধন করতে হবে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
কোথায় টিকা দেওয়া হবে
টিকাদান কার্যক্রম হবে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যালয়ের (যেমন সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়) মাধ্যমে দেওয়া হবে। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত টিকাদান হবে। দুজন টিকাদানকারী ও ৪ জন স্বেচ্ছাসেবীর সমন্বয়ে একটি টিম হবে। তারা প্রতিদিন ১০০-১৫০ জনকে টিকা দেবেন। খসড়া পরিকল্পনা অনুসারে ৭ কিস্তিতে (প্রতি কিস্তিতে ২ রাউন্ড) সর্বনিম্ন ৯৮ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৩৯২ দিনে কার্যক্রম শেষ করা হবে।
টিকা সংরক্ষণ পদ্ধতি
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা এলে তা ইপিআইর ঢাকা শহর ও জেলা পর্যায়ে থাকা গুদামগুলোতে সংরক্ষণ করা হবে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্সের এক সদস্য জানিয়েছেন, করোনার টিকা আসার পর এগুলো প্রথমে ঢাকায় সংরক্ষণ করা হবে। সেখান থেকে জেলা শহরে থাকা গুদামে রাখা হবে। সেখান থেকে উপজেলায় পাঠানো হবে। এসব টিকা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ৩ মাস রাখা যাবে।
ওই সদস্য আরও জানান, যে টিকা আসছে তা সাধারণত ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। দেশে শিশু ও মায়েদের যে টিকা দেওয়া হয় সেগুলোও একই তাপমাত্রায় রাখা হয়। ফলে করোনার টিকা মজুদ নিয়ে সমস্যা নেই।