ডেস্ক রিপোর্ট-
কখনো উপস্থাপিকা বা কখনো সাংবাদিক আবার কখনো কণ্ঠশিল্পী; রাজনীতি থেকে শুরু করে যেন প্রায় সব পেশায় যুক্ত তিনি। মন্ত্রী, এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা অসংখ্য ছবি তার ফেসবুকে শোভা বর্ধন করে চলেছে। তিনি ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর, যার অযুক্তিক বক্তব্যে হাস্যরসের জন্ম দেয়া ছিল নৃত্যদিনের ঘটনা।
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে প্রতিনিয়ত আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও বিভিন্ন সময় রাজনীতি করবেন না বলেও ঘোষণা দিতেন। ‘প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্যের’ জোরে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতেও পদ পেয়ে গিয়েছিলেন। পদ পেয়ে যান তৃণমূলের কমিটিতেও। সেই পদগুলো খোয়া যাওয়ার পর এখন বেরিয়ে আসছে হেলেনার নানা কীর্তিকাহিনী।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের ছবি যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে, তেমনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচ এম এরশাদসহ বিভিন্ন নেতার সঙ্গে তার ছবি বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
বলা হচ্ছে, শুধু আওয়ামী লীগ নয় নিজের উদ্দেশ্য পূরণে সবার সঙ্গেই সখ্যতা গড়ার চেষ্টায় ছিলেন হেলেনা। বিশেষ করে চার দলীয় জোট সরকারের আমলে দেশে শীর্ষ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ক্ষ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। তার সঙ্গে সখ্যতা ছিলো বিএনপি জোটের শীর্ষ নেতাদের। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে নিজেকে পাল্টে ফেলেন তিনি।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্থান পাওয়ার পর থেকে অনেকটাই ফুলে ফেঁপে উঠেন হেলেনা জাহাঙ্গির। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আবদুল মতিন খসরু মারা গেলে মনোনয়নের জন্যও ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন তিনি। ছবি ছাপিয়ে ব্যাপক প্রচারও চালিয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় ফরম সংগ্রহ করলেও মনোনয়ন পাননি হেলেনা। পরে আবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র পদে নির্বাচন করার জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন।
শুধু রাজনীতিই নয়, দেশে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ইস্যুতেই বেঁফাস ও ভিত্তিহীন বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচিত ব্যক্তি হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত হেলেনা জাহাঙ্গীর। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতে অংশ নিয়েও অযুক্তিক কথা-বার্তা বলতেন তিনি।
কয়েক বছর আগে (২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে) ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে তথ্য অধিদপ্তর থেকে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নেন হেলেনা। ওই অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডের একটি ছবি পোস্ট করে তার কার্যকারিতা সম্পর্কে তিনি নিজেই জানেন না বলেও জানিয়েছিলেন। তার ওই স্ট্যাটাস ও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড পাওয়ার প্রাপ্যতা নিয়ে পেশাদার সাংবাদিকদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে ট্রলের সৃষ্টি হয়।
অবশ্য পরবর্তিকালে হেলেনা জাহাঙ্গীর নিজেই একটি অনলাইন টিভি চালু করেন। তার টেলিভিশনের নাম ‘জয়যাত্রা’। এটির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তিনি। এরপর থেকে তিনি নিজেকে আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবেও পরিচয় দেন।
হেলেনা জাহাঙ্গীর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তিনি আন্দোলনকারীদের খাবার সরবরাহসহ নানা তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন। আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্যও দিয়েছিলেন তিনি। শুধু ওই আন্দোলনই নয়, অন্যান্য ইস্যুতেও বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় থাকতেন তিনি। আলোচনার বদলে তার বক্তব্যে সমালোচনাই বেশি হতো।
সম্প্রতি (৩ এপ্রিল) দেশে কঠোর বিধিনিষেধ চলা অবস্থায় কারখানা চালুর সমালোচনাকারীদের তুলোধুনো করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন হেলেনা জাহাঙ্গীর। যদিও পরদিনই সুর বদলে ক্ষমা চান তিনি। তবে ক্ষমা চাইতে এসেও আরো কিছু অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দেন তিনি। ওই ঘটনায় হেলেনার সমালোচনায় তোলপাড় শুরু হয়েছিল।
হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে থাকেন। ফেসবুক লাইভে এসে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায় তাকে। তাতে প্রায় সময় অযুক্তিক বক্তব্য দিতেন। আর এ নিয়ে লাইভে বিভিন্ন সময় তাকে ক্ষমা চাইতেও দেখা যায়।
শুধু বক্তব্যেই নয়, গেলো বছর এক ইফতার মাহফিলে জন্মদিন উদযাপন ও রোমান্টিক গান পরিবেশন করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন হেলেনা জাহাঙ্গীর। ওই বছর দেশের প্রবীণ একজন টেলিভিশন মালিকের সঙ্গে গানের অফার পেয়েছেন বলে ফেসবুকে পোস্ট দেন তিনি। ভিত্তিহীন ওই পোস্টের জন্য সেসময় তাকে বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল।
হেলেনা জাহাঙ্গীর সর্বশেষ ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন ফেসবুকে নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে। বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সংগঠনটির জেলা, উপজেলা ও বিদেশি শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ওই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হেলেনা জাহাঙ্গীর। আর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মনির।
মূলত চাকরিজীবী লীগের এই পোস্টার নিয়েই বিতর্কে পড়েন হেলেনা জাহাঙ্গীর। সংগঠনটির দাবি, দুই-তিন বছর ধরেই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছে তারা। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, সংগঠনটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই।
‘ভুয়া’ রাজনৈতিক দল গঠনে একশানে যায় আওয়ামী লীগ। দলের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্যপদ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘হেলেনা বুঝে না বুঝে যা ইচ্ছে তাই করছেন। এগুলো আমাদের না জানিয়েই করেছেন। যেহেতু সে নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছে, তাই তার সদস্যপদ আমরা বাতিল করে দিয়েছি।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে। তার বিভিন্ন কার্যকলাপ আওয়ামী লীগকে বিব্রত করেছে। এ নিয়ে দলের ভেতরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেন। এরপরই তাকে দল থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে তৃণমূল কমিটি থেকেও বাদ দেয়া হয়।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দার সদস্যরা হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আর্থিক দুর্নীতির খোঁজ নিতে শুরু করেছেন। তার চলাফেরার ওপরও নজরদারি চলছে। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া নানা সময়ে দেয়া তার বক্তব্য খোঁজা হচ্ছে।
একাদিক সূত্র বলছে, গোয়েন্দারা এরই মধ্যে হেলেনার বিরুদ্ধে পাওয়া কিছু দুর্নীতির মৌখিক তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। দলের নাম ভাঙিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া বিএনপি, জামায়াত-শিবিরসহ দেশের বাইরের কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগসূত্র থাকার তথ্য জানার চেষ্টা চলছে।