নিজস্ব প্রতিবেদক,
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় থমকে গেছে বিশ্ব, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। দেশে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ায় গত মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নেই পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ। হাতে এখন অজস্র সময়। এ সময়টা কাজে লাগিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভাব হয়েছেন। শিক্ষাজীবনেই স্বাবলম্বী হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তেমনি দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী এলিজা সাবরিন অণু। অন্য সবার মতো তিনিও পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন। এর বাইরে অনলাইনে অযথাই অবসর সময় কাটাতেন। এই করোনাকালীন অফুরন্ত সময় কাজে লাগানোর প্রয়াস হিসেবে তিনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন।
অণুর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প জানাচ্ছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. মাসুদ রানা।
উদ্যোক্তা জীবনের শুরু কবে থেকে এবং কীভাবে?
শুরু করেছি এই করোনাবন্দি সময়ে। জুন-২০২০। মায়ের অফলাইন বিজনেসের তিনটা বেডশিট আর পাঁচটা জামা ছিল। আর আমার অবসরে বানানো ৫টা কুশন কভার। আমি আর আমার জীবনসঙ্গী ডা. স্বাধীন বিন আমিন মিলে ঠিক করি এগুলো দিয়েই শুরু করব। গত জুনের ১৫ তারিখে আমাদের পেইজ ‘টুইঙ্কেল বুটিক’ খুলে উদ্যোক্তা জীবন শুরু করি। আর নিয়মিত প্রোডাক্ট এর ছবি পোস্ট করতে থাকি। তেমন রেসপন্স না পেলেও এ বিষয়ে উই থেকে বিভিন্ন কিছু শিখছিলাম। আস্তে আস্তে আমার প্রোডাক্ট এর পছন্দকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেই থেকে আমার কাজের প্রতি আগ্রহও বাড়তে থাকে।
করোনার আগে থেকেই কী এমন ভাবনা ছিল?
হ্যাঁ, ভাবনা আগে থেকেই ছিল একটা বুটিক্স দেওয়ার। কারণ, ছোট থেকেই আমি আমার ড্রেস নিজেই ডিজাইন করে বানিয়ে পড়তাম। তো এসব বিষয়ে আমার আগ্রহ অনেক। কুশন-কভার বানিয়ে ঘর সাজাতাম আর ভাবতাম এগুলো তো বেশ ভালো পারি। পড়া শেষে চাকরি পেতে দেরি হলে এই কাজই করব। তবে ভাবনা পর্যন্তই ছিল। করোনার কারণে তা দ্রুত বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়েছি।
উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছাটা কীভাবে আসলো?
প্রথমত, মেয়েরা প্রচণ্ডভাবে মায়ের অনুকরণপ্রিয় হয়ে থাকে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। ছোট থেকেই মাকে দেখতাম বুটিক্স এর কাজ করতে। মার কাছেই হাতেখড়ি হয় আমার। মায়ের অফলাইনের ছোট্ট একটা বুটিক্স ছিল। গত বছর থেকে আমার মা অসুস্থ থাকায় এটা আর সামনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই শুরুতেই এটাই মাথায় এসেছে, অলসভাবে সময় নষ্ট না করে কিছু একটা করা উচিত, আর তা বুটিক্স নিয়েই।
দ্বিতীয়ত, এই ইচ্ছা আরও প্রবল রূপ নিয়েছে ‘উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)’ এর কারণে। এখানে মার্চ থেকেই যুক্ত ছিলাম। সব মেয়েরাই কিছু না কিছু করছে। কেউ বসে নেই। আমি তো অনেক কিছুই পারি তবে আমি কেন পিছিয়ে থাকব। মূলত এই ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়া।
শুরুর দিকে পুঁজির যোগান কীভাবে দিয়েছিলেন?
একটা কথা আছে- ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। ঠিক সেটাই হয়েছে। খুব অল্প সময়ের পরিকল্পনায় কাজ শুরু করেছিলাম। ইদে কেনাকাটা করার জন্য বাবা আমাদের ১২ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। করোনার কারণে তো বাইরে যাচ্ছিনা কেউ। আমি ডা. সাহেবকে বললাম এবার শপিং করব না। এটা দিয়ে কিছু প্রোডাক্ট আনাব। যদি ভালোভাবে কাজ করতে পারি ইনশাআল্লাহ পরে অনেক শপিং করতে পারব। আলহামদুলিল্লাহ তাই হয়েছে। পরে অবশ্য আমার মা অনেক সাহায্য করেছেন।
খুব বেশি আগ্রহী ছিল সবাই। আমাকে সবাই অনেক সাহস জুগিয়েছেন। বাবা-মা, ভাই-বোন, কাছের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের সাপোর্ট পেয়েছি খুব। আর বিশেষ করে যার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি ছিল তিনি হলেন ডা. সাহেব। যিনি শুধু সাহস নয়, প্রতিটা পদক্ষেপে আমার সাথে থেকেছেন, সাপোর্ট করেছেন, ছায়ার মতো লেগে ছিলেন। পেশায় তিনি ডেন্টিস্ট হওয়া সত্ত্বেও অর্ডার নেওয়া থেকে শুরু করে কুরিয়ার করা পর্যন্ত কোনোরকম ঝামেলায় আমাকে পড়তে দেননি। একসাথে সব করেছি। সত্যিই বলতে গেলে তার জন্যই আমি এতদূর এগোতে পেরেছি।
প্রচার-প্রচারণার মাধ্যম কি ছিল?
প্রচার- প্রচারণার মাধ্যম পুরোটাই ফেসবুক গ্রুপগুলো। উই এর পাশাপাশি বিডিএফ ই-কমার্স, ই-উদ্যোক্তা আর এখন রংপুরের ‘হ্যালো রংপুর’ (উদ্যোক্তা কেন্দ্র) এ নিয়মিত পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করে যাচ্ছি।
শুরুর দিকে কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?
শুরুতে একদমই রেসপন্স পাইনি ১০ দিনের মতো। জুলাই এর ৬ তারিখে চাঁদপুর এর একজন আপু তিনটা জামার অর্ডার দেন। তারপর থেকে আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আল্লাহর রহমতে এবং সবার দোয়ায় এখন আমার কাস্টমার সংখ্যা ১৯০। তার মধ্যে কিছু রিপিট কাস্টমারও আছেন, যারা কিনা চতুর্থবারের মতো আমার কাছে অর্ডার করেছেন।
কোন ধরনের পণ্য দিয়ে প্রথম শুরু করেছিলেন?
ব্লক ডাইংয়ের বেডশিট, থ্রি-পিস, ডিজাইন করা কুশন কভার এবং হাতের কাজের থ্রি-পিস দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার কাছে এগুলোর পাশাপাশি থ্রি-পিস আর বেডশিটের অনেক কালেকশন আছে। সেই সাথে আরও আছে লেডিস টি-শার্ট, ছেলেদের লুঙ্গি আর এখন শীতের কালেকশনও রেখেছি ব্লক ও স্কিন প্রিন্টের শাল।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা কি?
ছোট্ট করে শুরু করা আমার এই ‘টুইঙ্কেল বুটিক’ রংপুরসহ সাড়া বাংলাদেশে এত দ্রুত ছড়িয়ে যাবে কখনও ভাবিনি। তবে এর পরিধি বাড়ার সাথে সাথে আমার স্বপ্ন আর ইচ্ছেগুলোও বড় হয়েছে। স্বপ্ন দেখছি, আমার ‘টুইঙ্কেল বুটিক’ একদিন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে। সারা বাংলাদেশে সবাই ‘টুইঙ্কেল বুটিক’ এক নামে চিনবে।
সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
সমস্যার বিষয়টি উদ্যোক্তাভেদে একেকরকম। তবে কমন সমস্যা হচ্ছে ফোকাস হারিয়ে ফেলা। অনেকেই একসঙ্গে অনেক কিছু করার চেষ্টা করেন যা ঠিক নয়। হতে পারে আপনার চমৎকার অনেক আইডিয়া আছে কিন্তু সবগুলো একসঙ্গে না করে শুরুতে একটি আইডিয়া নিয়ে আগানো উচিত। অন্য আইডিয়াগুলোকে তুলে রাখুন সুসময়ের জন্য। অনেকগুলো আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে একটিতে সময় একটু খারাপ গেলে তা সমাধানের চেষ্টা না করেই আরেকটিতে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমরা নবীন উদ্যোক্তারা অভিজ্ঞতার অভাবে বুঝি না একটি আইডিয়া নিয়ে এগোলে কী কী সমস্যা হবে বা কোনো আইনি জটিলতা আছে কিনা। কারণ বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখার দক্ষতাটা সবার থাকে না।
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
তরুণদের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে- আসলে কী করতে চান। আধুনিক যুগে ব্যবসার নতুন নতুন পথে হাঁটতে পারেন তারা। তবে হুট করে ব্যবসায় না নেমে চিন্তা-ভাবনা করে নামা উচিত। আগে বাঁধাগুলো চিহ্নিত করে, তা কীভাবে দূর করা সম্ভব সেই পলিসি নিয়ে ব্যবসায় নামতে হবে। আর একটি বড় বিষয় হলো ধৈর্য। এটা না থাকলে কেউ সফল উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এর সাথে সততা ও পরিশ্রম অবশ্যই প্রয়োজন। তাই তরুণদের বলব সময় পেলে তা অলসভাবে নষ্ট না করে সঠিক কাজে লাগাতে। কারণ পড়া শেষ করে চাকরি পেতে যেখানে আমার আরও ৪ বছর লেগে যেত, সেখানে আমি এখন থেকেই কাজ শুরু করে নিজেই স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। তাই যে যা পারে তা নিয়েই যাতে নিজের মতো কিছু করার চেষ্টা করে যায়। তাহলে আগামী দিনে তরুণদের বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে না। পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই ইনশাআল্লাহ।
বিএসডি/আইপি