নিজস্ব প্রতিবেদক
ব্যাংক খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ দেশের উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতা ও ব্যবসার পরিবেশকে সংকুচিত করে ফেলেছে মন্তব্য করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।
শনিবার (২৮ জুন) ঢাকা চেম্বার কার্যালয়ে ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ : ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য উঠে আসে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) ড. মো. ইজাজুল ইসলাম।
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ২০২৫ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪.২ লাখ কোটি টাকা, যা মোট অনাদায়ী ঋণের ২৪ শতাংশের বেশি। এই অবস্থান দেশের আর্থিক খাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনারই প্রতিফলন। উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন মুদ্রানীতি, আর্থিক নীতিমালা ও ব্যাংকিং কাঠামোতে কার্যকর সমন্বয়। একইসঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ের গতি বাড়াতে হবে, এসএমই খাতের পুনর্জাগরণে প্রয়োজন নীতিগত সময়সীমা বর্ধিত করা।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আরও তাসকীন আহমেদ বলেন, উদ্যোক্তাদের আস্থার অভাব, আর্থিক খাতে অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও খেলাপি ঋণ আদায়ের ধীরগতি প্রভৃতি বিষয়গুলো আমাদের শিল্প উৎপাদন, বিশেষ করে এসএমই খাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে, সেইসঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ৭.৫ শতাংশে নেমে আসার এবং ১০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির হার বিদ্যমান অবস্থাকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে একটি সহায়ক ব্যবসায়িক পরিবেশে নিশ্চিতের লক্ষ্যে মুদ্রানীতির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নীতিমালার মধ্যকার কার্যকর সমন্বয় ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমাদের অবশ্যই আনুষ্ঠানিক খাতকে রক্ষা করতে হবে, তা না হলে অনানুষ্ঠানিক খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে আর্থিক ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয়ের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। সেইসঙ্গে তিনি আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট নীতির সমন্বয় ও নীতির অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেন।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলো চাইলেই সুদের হার কিছুটা হলেও কমাতে পারে, যার ফলে ঋণ গ্রহীতারা বিশেষকরে এসএমই উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ইজাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই-আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ও মুদ্রা বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করার পর উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে, এর সুফল বিশেষ করে দেশের বেসরকারি খাত দেখতে পাবে। আর্থিক খাতের বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশকিছু নীতিমালা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা স্থিতিশীলতা আনয়নে সহায়তা করবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও বেশকিছু ব্যাংক বেশ ভালোভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে, যদিও তাদের ঋণের সুদের হার অনেক বেশি এবং ব্যাংকগুলো চাইলে তা হ্রাস করতে পারে, ফলে উদ্যোক্তারা আরও স্বস্তিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ঢাকা চেম্বারের সদ্য সাবেক সভাপতি ও পরিচালক আশরাফ আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার মধ্যে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহ ঘাটতি, আমদানি নিষেধাজ্ঞা, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার, বেসরকারি খাতে অপ্রতুল ঋণ প্রবাহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কেবল অদক্ষতার কারণেই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অতিরিক্ত দরে জ্বালানি ক্রয় করতে হচ্ছে এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের এর জন্য উচ্চমূল্য প্রদান করতে হচ্ছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহের অভাবে শিল্পের উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যদিও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে পণ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব ছিল। ২০২৫ সালে ঋণের সুদ হার গড়ে ৯ হতে ১৪ শতাংশ উন্নীত হওয়ার কারণে বেসরকারি খাতকে ১.৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা অতিরিক্ত সুদ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে।
এছাড়াও সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার, বিকেএমইর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান এবং র্যাংগস মটরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানা রউফ চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন।
বিএবির সভাপতি আব্দুল হাই সরকার বলেন, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ থাকলেও বেসরকারি খাতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ততটা সুদৃঢ় নয়, ফলে অনেকক্ষেত্রে তারা ব্যবসা ও বিনিয়োগের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকেন না। সরকারের দুর্বল নীতির কারণে খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের হারও বেশ শ্লথ। এছাড়াও প্রয়োজনের তুলনায় অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম থাকায় এক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিকেএমইর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ভালো ঋণ গ্রহীতারা আর্থিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। ডলারের রেট বৃদ্ধি হলেও উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ক্রেডিট না বাড়ার কারণে বিশেষ করে এসএমইরা প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছেন।