ঘরের মাঠে সমীকরণটা স্পষ্ট ছিল লিভারপুলের সামনে—কোনোভাবেই গোল হজম করা যাবে না। অন্তত দুটো গোল করতে হবে। সেই মাঠ অ্যানফিল্ডে যাওয়ার সময় ‘অলরেড’ সমর্থকদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আতিথ্য-ই পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ।
তাদের ছুঁড়ে মারা বোতলের আঘাতে গুঁড়িয়ে যায় রিয়াল খেলোয়াড়দের বহনকারী বাসের জানালার একটি কাচ। কিন্তু ওই পর্যন্তই, রিয়ালের বিপক্ষে অতটুকুই যা করতে পেরেছে লিভারপুল। শত চেষ্টা করেও জালে আর বল পাঠাতে পারেনি। জিনেদিন জিদানের সাজানো রক্ষণ রিয়ালকে তুলে দিয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে।
রিয়ালের মাঠে প্রথম লেগ ৩-১ গোলে হেরেছিল লিভারপুল। কাল কোয়ার্টার ফাইনাল ফিরতি লেগ গোলশূন্য ড্র করে দুই দল। এতে ইংলিশ ক্লাবটিকে বিদায় করে ১৪তম শিরোপা জয়ের পথে গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ অতিক্রম করল রিয়াল। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে মাদ্রিদের ক্লাবটির প্রতিপক্ষ চেলসি।
বাসের কাচ ভাঙার ঘটনার জন্য লড়াই শুরুর আগে রিয়ালের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল লিভারপুল। ভয়াবহ হিলসবরো দুর্ঘটনার ১০৯ বছর পূর্তি হিসেবে মাঠে নীরবতাও পালন করেছে দুই দল। কিন্তু ম্যাচটা যে ম্যাড়ম্যাড়ে হবে না তা জানতেন সবাই।
দুই মৌসুম আগেও সেমিফাইনাল প্রথম লেগে বার্সার মাঠে ৩-০ গোলে হারের অ্যানফিল্ডে ফিরতি লেগে ৪-০ গোলের দুর্দান্ত জয়ের প্রেরণা লিভারপুলের সামনেই ছিল। পার্থক্য শুধু, সেবার অ্যানফিল্ডের গ্যালারিতে সমর্থকদের পেয়েছিল লিভারপুল। এবার দর্শকেরা থাকলেও কি তা হতো? জয়ের কাজটা তো করতে হয় খেলোয়াড়দের, আর সে কাজে যদি প্রথমার্ধেই ন্যূনতম দুটি গোলের সুযোগ নষ্ট হয়, পরের অর্ধে আরও কয়েকটি—তাহলে দর্শকদের সমর্থন কতটা কাজে আসত? কাল লিভারপুল এই সুযোগ নষ্টের ব্যর্থতায় পুড়েছে।
আর রিয়াল কোচ জিনেদিন জিদান ধন্যবাদ দিতে পারেন তাঁর ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড থেকে রক্ষণভাগের সব সেনানীকে। একবার ভেবে দেখুন, রক্ষণভাগের নেতা সের্হিও রামোস নেই, রাফায়েল ভারান, লুকাস ভাসকেজ, দানি কারবাহালদের মতো অভিজ্ঞদেরও পাননি জিদান। রাইটব্যাক পজিশনে ‘মেক শিফট’ হিসেবে খেলেছেন ফেদে ভালভার্দে। মাঝের রক্ষণ সামলেছেন নাচো ও এদের মিলিতাও।
তাও যেনতেনভাবে সামলানো হয়, রিয়ালের বক্সে উড়ে আসা বেশির ভাগ ক্রস ‘ক্লিয়ার’ করার পাশাপাশি ম্যান মার্কিংয়েও দারুণ ছিলেন নাচো ও মিলিতাও। জটলার ভেতর থেকে মোহাম্মদ সালাহ, রবার্তো ফিরমিনোদের নেওয়া শটগুলোও পথভ্রষ্ট করেছেন তারা। ঠিক তাদের সামনে আসল কাজটা সারাক্ষণ করে গেছেন কাসেমিরো।
মাঝমাঠের অর্ধ থেকে রিয়ালের বক্সের সামনে লিভারপুল খেলা তাদের ইচ্ছেমতো গোছাতে পারেনি এই ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের জন্য। প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাৎ করতে কাল তাঁর কোনো জুড়ি ছিল না।
লিভারপুল কিন্তু তবুও সেমিফাইনালে ওঠার সুযোগ পেয়েছে দুই অর্ধেই। প্রথমার্ধের শুরুর ঝড়েই দুটো গোলের সুযোগ নষ্ট করেছেন সালাহ-মিলনাররা। রিয়াল গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার হাতে সরাসরি বল তুলে দেন সালাহ। এ সময় কোর্তোয়া দুটি দারুণ সেভও করেন। ডান প্রান্তে ফেদে ভালভার্দের রক্ষণে অনভিজ্ঞতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেদিক দিয়ে বারবার আক্রমণ করেছে লিভারপুল।
ওদিকে রিয়ালের কাজ ছিল ঠান্ডা মাথায় রক্ষণ সামলে খেলাটা ধীর গতির করা, সময় নেওয়া। মিডফিল্ডার লুকা মদরিচ এ কাজটা করে গেছেন ম্যাচের পুরোটা সময়। তবে গোলের সুযোগ নষ্টে সালাহকে বেশি দুষতে পারেন লিভারপুল সমর্থকেরা। দুই অর্ধের শুরুতে ন্যূনতম তিনটি সুযোগ ছাড়াও শেষ দিকেও গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি মিসরীয় তারকা।
ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আর্নল্ডের ক্রস থেকে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে গোলের সুযোগ নষ্ট করেন ফিরমিনো। সরাসরি কোর্তোয়ার হাতে বল পাঠান ব্রাজিলিয়ান তারকা। এ সময় সাদিও মানে নিজেও রিয়ালের বক্স থেকে শট না নেওয়ায় গোলের দুটি ভালো সুযোগ নষ্ট করেন। গোলের সুযোগ পেয়েছিল রিয়ালও।
একটু নিচে নেমে খেলে বল কেড়ে নেওয়ার কাজটা করছিলেন করিম বেনজেমা। ফরাসি তারকা কাল প্রচুর দৌড়ে খেলেছেন। এভাবেই লিভারপুলের বক্সে বল পেয়ে গোলপোস্টে লাগান তিনি। তবে রিয়ালের খেলা দেখে মনে হয়েছে, আক্রমণের চেয়ে রক্ষণেই বেশি মনোযোগ তাদের।
যে দলটি প্রথম লেগে গতিময় ফুটবল খেলেছে, সে-ই দলটাই কি না ফিরতি লেগে খেলল জমাট, ধীর-স্থির অনেকটাই ‘বাস পার্কিং’ ফুটবল—সেটি যে দুই গোল ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় তা না বললেও চলে, কিন্তু দলের মানসিকতা এভাবে পাল্টে ফেলার কৃতিত্বটা জিদানকে দিতেই হবে।
গোটা ম্যাচে রিয়ালের গোলপোস্ট তাক করে মোট ১৫টি শট নিয়েছে লিভারপুল। সে তুলনায় রিয়াল নিতে পেরেছে মাত্র ৬টি শট। সেট পিসও কাজে লাগাতে পারেনি স্বাগতিকেরা। ১১টি কর্নার পেয়েও বাতাসে নিজেদের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারেনি লিভারপুলের ত্রিফলা আক্রমণভাগ।