ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আমরা চন্দ্র বছরের জিলহজ্ব মাস পার করছি। জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখকে ইয়াওমে আরাফা বা আরাফা দিবস বলে।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দিন আরাফাতের দিন অর্থাৎ ৯ জিলহজ, যে দিন পবিত্র হজ পালিত হয়। আর শ্রেষ্ঠ রাত লাইলাতুল কদর। রমজানের শেষ দশকের রাজমুকুট হলো কদর রজনী। আর জিলহজের প্রথম দশকের গৌরব হচ্ছে আরাফাতের দিন। মানবজাতি ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে ঘটনাবহুল
আরাফাতের দিনের ফজিলত, বৈশিষ্ট্য ও করণীয় সম্পর্কে আসুন জেনে নিই:
গতবারের মতো এ বছরও পবিত্র হজ পালিত হবে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে। সীমিত পরিসরে ও কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সৌদি আরবে শনিবার থেকে শুরু হয়েছে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা।বাইরের কেই সুযোগ না পেলেও সৌদি আরবে থাকা ১৫০টি দেশের নাগরিকসহ এবারের হজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ৬০ হাজার মানুষ।আজ পবিত্র হজ পালিত হতে হবে।সৌদি আরবে হিজরি মাস গণনা অনুযায়ী গতকাল ৮ জিলহজ। মক্কার অদূরে মিনার তাঁবুতে হাজীদের অবস্থানের দিন। ১৯ জুলাই সোমবার (৯ জিলহজ) মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন অর্থাৎ হজের দিন।মূলত ৮ জিলহজ ফজরের নামাজের পর থেকেই ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পাঠ করতে করতে হাজীদের মিনার তাঁবুতে গিয়ে অবস্থান করার নিয়ম। সে হিসাবে হজের দিনগুলোর সূচনা গতকাল থেকেই।নির্ধারিত স্থান (মিকাত) থেকে ইহরাম বেঁধে মিনায় অবস্থান করেই হাজীরা হজের সব করণীয় সম্পন্ন করবেন। সেখান থেকেই কাল আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে রওনা হবেন। দিন শেষে আরাফাতের ময়দান থেকে ফেরার পথে মুজদালিফায় রাত যাপন করে ১০ জিলহজ মঙ্গলবার সকালে আবার মিনার তাঁবুতে ফিরবেন। সেখান থেকে গিয়েই জামারাহতে শয়তানের প্রতি প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করবেন। পশু কোরবানি করবেন এবং তাওয়াফে জিয়ারাহ, সাফা মারওয়া সাঈ করে আবার মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন। পরের দুই দিনও একইভাবে মিনার তাঁবু থেকে গিয়ে জামারায় পাথর নিক্ষেপ করবেন। ১২ অথবা ১৩ জিলহজ পাথর নিক্ষেপ শেষ করে হাজীরা মিনার তাঁবু ত্যাগ করে হজের কর্তব্যের সমাপ্তি ঘটাবেন। এরপর মক্কা ত্যাগ করার আগে বিদায়ী তওয়াফ করে যে যার অবস্থানে চলে যাবেন।
মিনার তাঁবুতে হাজীরা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ তথা তালবিয়া পাঠ ছাড়াও ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। হজের মাসলা মাসায়েল নিয়ে নিজেরা আলোচনা করেন। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে মুনাজাত করেন।আজ মিনা থেকে হাজীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে অবস্থান নেবেন। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ। এখানে কেউ অবস্থান না করলে তার হজ আদায় হবে না।৯ জিলহজ ফজরের নামাজ পড়ে হাজীদের আরাফাতের উদ্দেশে রওনা দেয়ার নিয়ম। মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানের দূরত্ব ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার। অনেকে হেঁটে আরাফাতের দিকে রওনা হন। দুপুরের আগেই হাজীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে অবস্থান নেন। আরাফাতের ময়দানে মসজিদে নামিরাহ থেকে গ্র্যান্ড মুফতি জোহরের ওয়াক্ত শুরু হলেই খোতবা দেবেন। সেখানে জোহর ও আসরের নামাজের পরপর জামাত হবে। এরপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত ওই ময়দানে অবস্থান করে হাজীরা আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে কান্নাকাটি করে কাটাবেন। সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ময়দান ত্যাগ শুরু করবেন। মিনায় ফেরার পথে মাঝে মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করবেন। ১০ জিলহজ সকালে ওই ময়দান ত্যাগ করে মিনায় ফিরবেন।
মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভই হজ পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। হজের প্রতিটি কাজের মধ্যেই আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ, তার মুখাপেক্ষী হওয়া, তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং তার নির্দেশিত পথে বাকি জীবন পরিচালনার স্বীকৃতি ও অনুশীলনই প্রকাশ পায়। এ জন্য হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘হজে মাবরুর বা কবুল হওয়া হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ এ জন্য হাজীরা সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন আল্লাহ যেন হজ পালনকে সহজ করে দেন এবং তার হজকে ‘মাবরুর হজ’ হিসেবে কবুল করেন। আর এই আরাফার ময়দানে অবস্থানকালে বা এই দিনে হাজি সাহেবদের সাথে বিশ্বের সমস্ত মুসলমান কিছু নেক আমল করে থাকেন। আসুন, আমরাও এই নেক আমলগুলো সম্পর্কে জেনে নিই এবং পালন করে নেক লাভ করি।
রোজা রাখা এ দিন রোজা রাখা সুন্নত। যা আগামী ও গত মোট দুই বছরের ছোট গুনাহ থেকে আপনাকে পরিত্রাণ দেবে।জামাতের সাথে নামাজ আদায়
চেষ্টা করতে হবে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করতে।তাকবিরে তাশরিক যাঁরা আগামীকাল ঈদুল আজহা পালন করবেন, এ দিন থেকে ফরজ নামাজগুলোর পর নির্ধারিত তাকবির পাঠ করবেন তাঁরা। এটি পাঠ চলবে আগামী ১৩ জিলহজ পর্যন্ত।
তাকবিরটি নিম্নরূপ
আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ(এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশসহ মুসলিমবিশ্বের আরো কিছু দেশে যাঁরা আগামী ২০ জুলাই ঈদুল আজহা পালন করবেন তাঁদের জন্য আজ ১৯ জুলাই ফজরের নামাজের পর থেকে তাকবিরে তাশরিক পাঠের নিয়ম।)
* ইশরাকের নামাজঃ-সূর্যোদয়ের ১৫-২০ মিনিট পর ইশরাকের নামাজ আদায় করা উত্তম।
জিকির, তওবা, ইসতেগফার
এ দিন সারাদিনই বেশি বেশি জিকির, তওবা ও ইসতেগফার পাঠ করা খুব ভালো।দরুদ পাঠ ও কোরআন তেলাওয়াত বেশির থেকে বেশি দরুদ শরিফ পাঠ এবং কোরআন তেলাওয়াত করা খুবই ভালো।আরাফাতের দিনের দো’আ
আরাফর দিনে হাজি সাহেগণ জোহর থেকে আসরের মধ্যে একটি বিশেষ দো’আ পাঠ করে থাকেন। নেক আমলের অংশ হিসেবে সব মুসলমানই এটি পাঠ করতে পারেন।
এই দো’আটি প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, শ্রেষ্ঠ দো‘আ হচ্ছে আরাফাত দিবসের দো’আ। দো’আটি নিচে উল্লেখ করা হলো :[লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মূলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাই’ইন ক্বদীর]একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব-ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরিক নেই; রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর; আর তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে হজ। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিমদের ক্ষেত্রে জীবনে অন্তত একবার হজ করা ফরজ। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ হজ করতে ইসলাম ধর্মের পবিত্র দুটি পবিত্র স্থানে যেতেন।সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যারা হজ পালন করবেন।তাদের সবাইকে টিকা দেয়া হয়েছে এবং তাদের বয়স ১৮-৬৫ বছর।গত বছর মাত্র ১০ হাজার সৌদি নাগরিক এবং বাসিন্দা হজ পালন করার অনুমতি পেয়েছিল।গত পাঁচ বছরে যারা হজ পালন করেননি এ বছর সেসব ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এছাড়া হজ করেননি ৫০ বছর বয়সী বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিদেরও অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এ বছর। এমনকি এবারই প্রথমবারের মতো পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হজের নিবন্ধন করার সুযোগ পেয়েছেন সৌদি নারীরা।
লেখক- এম এ কামিল হাদিস ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কার্যনির্বাহী পরিষদ
কো.চেয়ারম্যান,বাংলাদেশ রোগী কল্যান সোসাইটি।