নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একটা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমি সব সময় এটা বলি ‘আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা’। অসামান্য স্মরণশক্তি ছিল তার। বাংলাদেশের কয়েকটি বিষয়ে সঠিক সময়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেইগুলো সঠিক সময়ে আমার মা নিয়েছিলেন বলেই কিন্তু আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি।
রোববার (৮ আগস্ট) ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব-এর ৯১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন’ এবং ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব পদক-২০২১ প্রদান’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে যুক্ত হন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি মনে করি আমার মায়ের অনেক অবদান রয়ে গেছে দেশের রাজনীতিতে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মানুষের যে আর্থিক দুরবস্থা, মানুষের কী চাহিদা সে বিষয়গুলোও তিনি জানতেন এবং শিক্ষার প্রতি তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। কারণ আমার নানা শিক্ষিত ছিলেন। তিনি যশোরে চাকরি করতেন এবং তার খুব শখ ছিল যে তার দুই মেয়েকে তিনি লেখাপড়া শেখাবেন, বিএ পাস করাবেন। সে যুগে এ রকম চিন্তা করাটাও একটা দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটা সংগ্রামে আমার মায়ের অনেক অবদান রয়েছে। আপনারা জানেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকেই কিন্তু পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সব সময় রিপোর্ট দিত। সে রিপোর্টগুলো যে আমি প্রকাশ করেছি, সেখানে কিন্তু একটি জিনিস খুঁজে দেখেছিলাম যে কোথাও আমার মায়ের কথা লেখা আছে কি না। কিন্তু সেখানে তারা আমার মায়ের বিরুদ্ধে কিছুই লিখতে পারেননি। অথচ আমার মা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে গোপনে দলের লোকজনের সঙ্গে দেখা করা। ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। তাদের নির্দেশনা দেওয়া। এসব কাজে যাওয়ার সময় তিনি তার পোশাক পরিবর্তন করতেন। একটা বোরখা পরে, তারপরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বিশেষ করে পলাশী অথবা আজিমপুর কলোনিতে আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় যেতেন। সেখানে আমাদের রেখে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করা, তাদের দিক-নির্দেশনা দিয়ে আবার আসতেন। এসে তিনি আমাদের নিয়ে বাসায় ফিরতেন। এর বিস্তারিত আমার লেখায় আছে।
তিনি বলেন, আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু তার পাশে থেকে সব সময় প্রেরণা যুগিয়েছেন আমার মা। আমার মা কখনো সামনে আসেননি, কখনো কোনো মিডিয়ার সামনে যাননি। কখনো নিজের নামটাও ফলাতে চাননি। তিনি নীরবে পাশে থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার বাবাকে সহযোগিতা করে গেছেন, সমর্থন দিয়ে গেছেন। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ত্যাগ, বাবাও (বঙ্গবন্ধু) স্বীকার করে গেছেন।
তিনি বলেন, তার যে ধৈর্য ও সাহস এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া, যা আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বাস্তবায়ন করতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। আর পাঁচটা নারীর মতো বা সংসারের কর্ত্রীর মতো আমার মার যদি নানা রকমের চাহিদা থাকত, স্বামীর কাছে মানুষের অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকে, অনেক কিছু পাওয়ার থাকে। কত মানুষ কত কিছুই তো চায়, শাড়ি চায়, বাড়ি চায়, গহনা চায়। এটা চায় সেটা চায়। আমার মা কিন্তু কখনো কোনোদিন সংসারের বা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের বা আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারে বাবার কাছে তার কোনো চাহিদা ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বরং সব সময় তিনি এটাই বলতেন সংসার নিয়ে ভাবতে হবে না। আমাদের কথা চিন্তা করতে হবে না। তুমি দেশের কাজ করছ, দেশের কাজই করো। দেশের কথাই চিন্তা করো। তাই যখনই আমার বাবা কারাগারে গেছেন, মা কিন্তু সব সময় তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি কারাগারে গিয়ে সব সময় মাকে যে কথাগুলো বলতেন, একটা জিনিসের যে প্রেরণা দেওয়া, সেই প্রেরণাটাই তিনি দিয়ে গেছেন সারাজীবন। আমি যতটুকু জেনেছি। যতটুকু লিখেছি। তাতে আমিও চেয়েছি। আমার মায়ের কথাগুলো মানুষ জানুক।
তিনি বলেন, তার (বঙ্গমাতা) জন্মদিনটা আমরা পেলাম কীভাবে, সেটার পেছনে কিন্তু একটা ইতিহাস আছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটা। এই বাড়িটা কিন্তু খুব ধীরে ধীরে, আস্তে আস্তে করা। এক চোটে করা সম্ভব হয়নি। সেখানে আব্বা আজকে জেলে, কালকে বাইরে। আমার মা’ই উদ্যোগ নিয়ে শুরু করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকায় এসে আমাদের বাসা দেখতে আসেন। আবার যখন উনি ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার সময় উনি প্লেনে কয়েকটা সিঁড়ি উঠে যান। আবার নেমে আসেন। নেমে এসে আমার আব্বাকে বলেন, মুজিব তোমার বাড়িটা তুমি হেবা করে তোমার স্ত্রীর নামে লিখে দাও। পকেট থেকে কিছু টাকাও তিনি বের করে দেন। কারণ হেবা করতে গেলে রেজিস্ট্রি করতে হবে। ট্যাক্স দিতে হবে। সেই জন্য তিনি নিজে কিছু টাকাও দিয়ে গেলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে, ৬২ সালের কথা। ৬১ কি ৬২ সালের দিকে, উনি টাকা দিয়ে গেলেন। হেবা করতে গেলে বিয়ের কাবিননামা দরকার। কাবিনামাটা ছিল আমার দাদার কাছে। কারণ আমার মায়ের বাবা মারা গেছেন তিন বছর বয়সে, মা মারা গেছেন পাঁচ বছরে। তার দাদা মারা গেছেন সাত বছরে। তখন দাদার সম্পত্তি মা এবং খালার নামেই দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই অর্পণ তিন বছর বয়সেই বিয়ে করে আমার দাদাকেই মোতয়াল্লি করে দিয়ে যান সমস্ত সম্পত্তির, তাকেই গার্জিয়ান করে দিয়ে যান।
তিনি বলেন, সেই কাবিননামাটা আমার দাদার কাছেই রাখা ছিল। সেই সময় কাবিননামাটা প্রয়োজন হয়। আমার দাদা ওটা নিয়ে আসেন। আমি, আমার খালাতো বোন ছিল জেনি এবং রেহানা আমরা, খুব আগ্রহ, যে কী লেখা আছে পড়ে দেখব। আমরা সেখান থেকেই কিন্তু মার জন্ম তারিখটা পাই। সেই থেকে আমরা ঘরে ছোট-খাটো করে মার জন্মদিন পালন করতাম। আমাদের বাসায় জন্ম তারিখ বা কোনো কিছু বেশি উৎসব করে করা হতো না। শুধু রেহানা তার জন্মদিনে বন্ধু-বান্ধবদের ডাকত। তাছাড়া আমরা সবাই খুবই ঘরোয়াভাবে। সেইভাবে কিন্তু মায়ের জন্ম তারিখটা আমরা পাই। পরে তো দাদা সেটা নিয়ে যান। আর একাত্তর সালে তো আমাদের টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেই বাড়িটা পুড়িয়ে দেয়। কাজেই সব পুড়েই যায়।
বিএসডি/এমএম