তাঁর বিরুদ্ধে এই সমালোচনাটা অনেক বেশিই ওঠে। ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে যতটা উজ্জ্বল, পোল্যান্ডের জার্সিতে তিনি ততটা উজ্জ্বল নন। আর ম্যাচ যদি বড় মঞ্চে কিংবা কঠিন কোনো দলের বিপক্ষে, রবার্ট লেভানডফস্কিকে নাকি পোল্যান্ডের জার্সিতে খুঁজেই পাওয়া যায় না।
ইউরোতে আজ পোল্যান্ডের প্রথম ম্যাচের পর সমালোচনাটার পালে আরও জোর হাওয়া লাগতে যাচ্ছে আর কী! রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে লেভানডফস্কি ছিলেন বায়ার্নের ‘লেভা’র ছায়া হয়ে, পোল্যান্ডও ২-১ গোলে হেরে গেছে মারেক হামসিক, মিলান স্ক্রিনিয়ারের স্লোভাকিয়ার কাছে।
ম্যাচের ৬২ মিনিটে মিডফিল্ডার গ্রেগর্জ ক্রিকোভিয়াক লাল কার্ড দেখলে শেষ ২৮ মিনিট দশজন নিয়ে খেলেছে পোল্যান্ড।
১৮ মিনিটে স্লোভাকিয়া এগিয়ে যায় ম্যাচে। গোলটা পোল্যান্ডের গোলকিপার ভইচেক শেজনির আত্মঘাতী হিসেবে লেখা হলেও বাস্তবে গোলটা বারবার স্লোভাকিয়ার রবার্ট ম্যাকেরই কথা বলবে।
বাঁ দিক থেকে দারুণ দৌড়ে দুই পোলিশ ডিফেন্ডারকে হতবুদ্ধি করে বক্সে ঢুকেছিলেন ম্যাক, এরপর তাঁর শট পোল্যান্ডের পোস্টের নিচের দিকে লাগে। ততক্ষণে শট ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শেজনি। এদিকে বল পোস্টে লেগে মাটিতে পড়ে থাকা শেজনির পিঠে লেগে উল্টো ঢুকে যায় জালে। ইউরোর ইতিহাসে আত্মঘাতী গোল করা প্রথম গোলকিপার বনে গেলেন শেজনি!
বিরতির আগে আক্রমণে নিষ্প্রাণ পোল্যান্ড দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামার ৪৬ সেকেন্ডেই সমতায় ফেরে। দারুণ দলীয় আক্রমণের শেষটা সুন্দর করে পোল্যান্ডকে সমতায় ফেরান মিডফিল্ডার ক্যারল লিনেত্তি।
স্লোভাকিয়ার জয়ের কৃতিত্বের বেশ বড় ভাগ যাবে দলটার কোচ স্তেফান তারকোভিচের দিকে। ম্যাচে দাবার চালের মতো একেকটি চাল দিয়েছেন, কৌশল বদলেছেন, প্রায় প্রতিটিতেই সফল। ৬২ মিনিটে পোল্যান্ডের ক্রিকোভিয়াক লাল কার্ড না দেখলে অবশ্য তা হতো কি না, সংশয় আছে।
প্রথমার্ধে নিষ্প্রাণ পোল্যান্ড যে দ্বিতীয়ার্ধে শুরুটা করেছিল দারুণভাবে! ৬২ মিনিট পর্যন্ত দারুণ দাপটও দেখাচ্ছিলেন লিনেত্তি-জিলিনস্কিরা। সে সময়ে লেভানডফস্কির সঙ্গে সমন্বয়টা দারুণ হচ্ছিল তাঁদের।
প্রথমার্ধে যা একেবারেই হয়নি। ওই ৪৫ মিনিটে স্লোভাকিয়ার পোস্টে পোল্যান্ড একটা শটও রাখতে পারেনি। সে সময়ে স্লোভাকিয়া ৫-৩-২ ছকে একেবারে ‘লো ব্লকে‘ ডিফেন্ডিং করছিল, অর্থাৎ নিজেদের বক্সের সামনে যেন মানবদেয়াল দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। পোল্যান্ডের আর সেটি ভাঙা হলো না।
কিন্তু ৬২ মিনিটে দ্বিতীয় হলুদ কার্ডে এবারের ইউরোর প্রথম লাল কার্ড দেখা খেলোয়াড় হলেন পোল্যান্ডের ক্রিকোভিয়াক। দ্বিতীয়ার্ধে দারুণ শুরু করা পোল্যান্ডও এরপর খেই হারাল। সেটির পুরো ফায়দা তুলে নিলেন ইন্টার মিলানে খেলা স্লোভাক ডিফেন্ডার মিলান স্ক্রিনিয়ার।
কর্নার থেকে পোল্যান্ড বক্সে বল আসে স্ক্রিনিয়ারের কাছে। দারুণ প্রথম স্পর্শে বল নিয়ন্ত্রণে আনেন স্লোভাক ডিফেন্ডার। এরপর ডানপায়ের ভলিতে বল জড়িয়ে দেন জালে।
শেষ পর্যন্ত সেই গোলই হয়ে থেকেছে ব্যবধানসূচক। অনেক চেষ্টা করেও আর ম্যাচে ফেরা হয়নি পোল্যান্ডের। হার দিয়ে ইউরো শুরু হলো লেভানডফস্কিদের। গ্রুপের অন্য দুই দল স্পেন ও সুইডেন আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় মুখোমুখি হবে।
সে সময় ফুটবল যে লাথি মারার বস্তু, এটি দিয়ে গোল করতে হলে প্রতিপক্ষের পোস্টের সামনে গিয়ে বলে শট নিতে হয়, তা-ই যেন ভুলে গিয়েছিলেন পোল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা। দু-তিনবার ঢুকেছেন বক্সে, কিন্তু বল নিয়ে বেশি পাস দিতে গিয়ে আর শট নেওয়া হয়নি।
উল্টোদিকে পাল্টা আক্রমণে সামনের তিন খেলোয়াড় অর্থাৎ হামসিকের পাশাপাশি ম্যাক ও অন্দ্রেই দুদার নৈপুন্যের ওপর ভরসা রেখে খেলছিল স্লোভাকিয়া। ১৮ মিনিটে ম্যাকের সৌজন্যে গোলও এসে গেল।
গোল খাওয়ার পর পোল্যান্ড কিছুক্ষণ কৌশল বদলে ক্রসের ওপর ভর করে খেলার চেষ্টা করেছে, মূলত ডানদিক থেকে রাইট উইংব্যাক কামিল জোজভিয়াক একের পর এক ক্রস দিয়ে গিয়েছিলেন বক্সে। কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছিল না। পোল্যান্ডের এমন কোনো সৃষ্টিশীল বা গতিশীল উইঙ্গারও নেই যে তাঁর কৌশলে বল নিয়ে ভেতরে ঢুকবে দলটা!
দ্বিতীয়ার্ধে তাই কৌশল বদলে ফেলেন পোল্যান্ড কোচ পাওলো সোসা। স্লোভাকিয়া রক্ষণে পাঁচজন রেখে খেলছিল, সোসাও তাই পাল্টা দিতে আক্রমণে লোক বাড়ান। লেভানডফস্কির পাশাপাশি তখন আক্রমণে লিনেত্তি, জিলিনস্কিদের অংশগ্রহণ বেড়ে গেল।
সেটির ফলে দ্বিতীয়ার্ধের ৪৬ সেকেন্ডেই গোল! কী দারুণ দলীয় আক্রমণের ফসল সেটি! বক্সের বাইরে লেভানডফস্কির পাস পেয়ে মাতেউস ক্লিখ দারুণ রিভার্স পাস দিলেন বক্সের ভেতরে ঢুকতে থাকা লেফটব্যাক মাসেইয়েই রিবাসের দিকে। রিবাস কাটব্যাক করতে দেরি করলেন না। তাতে বক্সের মাঝে থাকা লিনেত্তির প্রথম স্পর্শে শট। শটে জোর খুব একটা ছিল না, কিন্তু স্লোভাকিয়ার গোলকিপার মার্টিন দুভরাভকা ঝাঁপিয়েও তা নাগালে পেলেন না।
এর পাঁচ মিনিট পর আবার লিনেত্তির শট গেল বাইরে। তার দুই মিনিট পর কর্নার থেকে পোলিশ ডিফেন্ডার কামিল গ্লিকের শট গেল বার উঁচিয়ে। পোল্যান্ড তখন চেপে ধরেছে স্লোভাকদের। কিন্তু ভাগ্য তখনো যে অন্য গল্প লিখে রেখেছে লেভানডফস্কিদের জন্য।
ম্যাচের ২২ মিনিটে স্লোভাকিয়ার রোমাদাকে ফাউল করে প্রথম হলুদ কার্ড দেখা পোলিশ মিডফিল্ডার ক্রিকোবিয়াখ ৬২ মিনিটে আবার পেছন থেকে বাধা দেন সেই রোমাদাকেই। ফাউলটা বেশি গুরুতর ছিল না, কিন্তু সময়ের হিসেবে গড়বড় হলো ক্রিকোবিয়াখের। হলুদ কার্ড দিতেই হতো। দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখলেন তিনি। এবারের ইউরোর প্রথম লাল কার্ড!
পুরো ম্যাচের গল্পই সেখানে বদলে গেল। পোল্যান্ডের তবু যদি ড্র নিয়ে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন থেকে থাকে, সেটি মাটিতে মিলিয়ে গেল ৬৯ মিনিটে স্ক্রিনিয়ারের গোলে।
শেষদিকে পোল্যান্ড চেষ্টা করেছে বেশ। ৮৮ মিনিটে মোডারের নেওয়া কর্নারে লেভানডফস্কিদের কেউ মাথা ছোঁয়াতে পারলেই গোল হতো! ৮৯ মিনিটে ডিফেন্ডার বেদনারেক দুটি শট নিয়েছিলেন। প্রথমটি লাগেইনি ঠিকমতো, পরেরটি স্লোভাকিয়ার পোস্ট ঘেঁষে গেছে।
যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিটে বক্সের সামনে লেভানডফস্কি বল নামিয়ে দেন ক্যারল সুইডেরস্কির দিকে, তাঁর শটে গতি থাকলেও শটটা চলে যায় সোজা স্লোভাক গোলকিপারের দিকে।