নিজস্ব প্রতিবেদক:
নোয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বর্তমান নোয়াখালী জেলা আগে ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলা নিয়ে একটি বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনো বৃহত্তর নোয়াখালী নামে পরিচিত।
জানা যায়, নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। ইতিহাসবিদদের মতে, একবার ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী থেকে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে।
নোয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরি
নোয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৫ সালে (বাংলা ১৩০২) নোয়াখালী পুরান শহরে। ১৯৪৪ সালে যখন নোয়াখালী পুরান শহর মেঘনার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, তখন লাইব্রেরিটি স্থানান্তরিত হয়ে নোয়াখালীর প্রধান শহর মাইজদি কোর্টে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যবাহী এ লাইব্রেরিতে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার বই আছে। সংগ্রহভান্ডারে রয়েছে ব্রিটিশ ভারতের অনেক দুর্লভ বইও। শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে এ লাইব্রেরি এখনো জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বসাধারণের মাঝে।
নোয়াখালী জামে মসজিদ
নোয়াখালী শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক অপূর্ব স্বর্গীয় ভাবাবেগ নিয়ে অবস্থান করছে মাইজদী জামে মসজিদ। প্রতিদিন শত শত ধর্মপ্রাণ মুসল্লি নিয়মিত এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। ১৯৪১ সালের পুরাতন নোয়াখালী শহরের মরহুম ইমাম উদ্দিন সওদাগর নিজের জমিতে মসজিদটি স্থাপন করেছিলেন। মূল নোয়াখালী শহর মেঘনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার সময় সেই মসজিদটিও চিরতরে হারিয়ে যায়। পরে মাইজদীতে নতুন শহর গড়ার সময় ১৯৫০ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয়।
মসজিদটির মূল এলাকা প্রায় ৩ একর ৮০ শতাংশ। মসজিদটি তৈরির সময় ছোট এক তলা ভবনে অপরূপ মুসলিম ও দেশি লোকজ শিল্প-সৌন্দর্য লতাপাতা আর কোরআনের নানা আয়াত ও উপদেশবাণী খোদাই করে নির্মাণ করা হয়। মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৩০ ফুট ও প্রস্থ ৮০ ফুট। আয়তনে মূল ভবনে তিনটি সুদৃশ্য গম্বুজ ও নয়টি সুউচ্চ মিনার ইসলামি স্থাপত্যে নির্মিত হয়।
নিঝুম দ্বীপ
নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী তথা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। ১৯৪০-এর দশকে এই দ্বীপটি বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে ওঠা শুরু করে। চর গঠনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে ৪০-এর দশকের শেষ দিকে নিঝুম দ্বীপ তৃণচর বা গোচারণের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। মাছ ধরতে গিয়ে হাতিয়ার জেলেরা নিঝুম দ্বীপ আবিষ্কার করে।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুম দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুম দ্বীপে আসে। সমস্ত নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৩০০০ একরে মানুষের বসতি রয়েছে এবং জনগণের নিকট নিঝুম দ্বীপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও হরিণ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ।
উর্বর চরাঞ্চল
মেঘনা-বিধৌত নোয়াখালীতে জেগে ওঠা চরে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ বেশ প্রশংসনীয় ও কৃষকদের সাফল্যমণ্ডিত করে তুলেছে। এসব উর্বর চরাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ফসলের মধ্যে মৌসুমি ফসল ও শাকসবজি যেমন: তরমুজ, ধান, বাদাম, ডাল, আলু, ভুট্টা ইত্যাদি প্রচুর উৎপন্ন হয়।
বজরা শাহি মসজিদ
৩০০ বছরের মোঘল স্থাপত্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন বজরা মসজিদ। ১৭৪১ সালে মোগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহর রাজত্বকালে তার নির্দেশে ও অর্থে মিয়া আন্বরের সহযোগিতায় জমিদার আমান উল্যাহ খান দিল্লির শাহি মসজিদের অনুকরণে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। জমিদার আমান উল্যাহ তার বাড়ির সম্মুখে ৩০ একর জমির ওপর উঁচু পাড়যুক্ত একটি বিশাল দিঘি খনন করেন। এ দিঘির পশ্চিম পাড়ে মনোরম পরিবেশে আকর্ষণীয় তোরণ বিশিষ্ট প্রায় ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ৭৪ ফুট প্রস্থ এবং প্রায় ২০ ফুট উঁচু ৩ গম্বুজ-বিশিষ্ট এ ঐতিহাসিক মসজিদখানা নির্মাণ করেন। এ মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে ভিত তৈরি করা হয়। সুদৃশ্য মার্বেল পাথর দ্বারা গম্বুজগুলো সুশোভিত করা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে ৩টি ধনুকাকৃতি দরজা। মসজিদের প্রবেশ পথের ওপর রয়েছে কয়েকটি গম্বুজ। কেবল দেয়ালে ৩টি কারুকার্য খচিত মিহরাব আছে।
কমলার দিঘি
কমলার দিঘি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত। এ দিঘি নিয়ে অনেক পুরাণ এ এলাকায় প্রচলিত রয়েছে। দিঘির আকার ও বিশালত্ব একে অন্যরকম মর্যাদা দিয়েছে।
নোয়াখালী পুলিশ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য
মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালী পুলিশের অবদানস্বরূপ নোয়াখালী জেলা পুলিশ লাইনে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পুলিশের অবদানস্বরূপ ভাস্কর্য। প্রাথমিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পুলিশের উদ্যোগে জেলা পুলিশ লাইন থেকে অস্ত্র সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয় সে রকম একটি দৃশ্যের প্রতিবিম্ব নিয়ে তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। জেলা পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন নোয়াখালী পুলিশের মুক্তিযুদ্ধের অবদানস্বরুপ এ ভাস্কর্য নির্মাণকাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এখন অপেক্ষায় রয়েছে এর ভিত্তিপ্রস্থর উদ্বোধনের।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিনের পরিবারের সদস্যরা কর্তৃক দানকৃত শূন্য দশমিক ২০ একর জমিতে সরকারের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে একটি সুপরিসর ও সুসজ্জিত পাঠকক্ষ ছাড়াও অভ্যর্থনাকক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক ও লাইব্রেরিয়ানের জন্য আলাদা কক্ষ রয়েছে।
মেঘনা মোহনা
মেঘনা মোহনা স্থানীয়ভাবে চেয়ারম্যানঘাট নামে বহুল পরিচিত। জেলার মোট ৯টি উপজেলার একটি হাতিয়া, যেখানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই মোহনার অংশবিশেষ পাড়ি দিতে হয়। এ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে প্রাকৃতিক পরিবেশ আর অকৃত্রিম বিশুদ্ধ বাতাসে দেহ প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়।
গান্ধী আশ্রম
১৯৪৬-এর শেষ ভাগে সারা ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। তখন পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাব এসে পড়ে নোয়াখালীতে। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায় সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডবলীলা দেখা দেয়। আগুনে পুড়ে যায় বহু সাজানো সংসার। শান্তি মিশনের অগ্রদূত হয়ে নোয়াখালীতে ছুটে আসেন মহাত্মা গান্ধী। চৌমুহনীতে মহাত্মা গান্ধী জনসভায় প্রথম বক্তৃতা করেন। তারপর জনসেবা করেন দত্তপাড়া গ্রামে। ধারাবাহিকভাবে চলে তার পরিক্রমা। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারিতে তিনি জয়াগ গ্রামে এসে পৌঁছেন। সেদিনই নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার জয়াগ গ্রামের কৃতী সন্তান হেমন্ত কুমার ঘোষ তার জমিদারির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জনকল্যাণ খাতে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে মহাত্মা গান্ধীর নামে উৎসর্গ করেন। আশ্রম পরিচালনার ভার দেওয়া হয় গান্ধীর স্নেহভাজন শ্রীযুক্ত চারু চৌধুরীর ওপর।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নোয়াখালী জেলা শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে সোনাপুর-চরজব্বার সড়কের পশ্চিম পাশে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। দেশের একটি অন্যতম আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ১০১ একর জায়গার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। এটি বাংলাদেশের ২৭তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পঞ্চম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে ২০০৬ সাল থেকে। শুরুতে এই বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এখানে ১০টি বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে।
মহিষের দধি
নোয়াখালীর অনেকগুলো ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হলো মহিষের দধি। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মহিষের দুধ দিয়ে দধি তৈরি করা হয়। উৎপাদিত মহিষের দধি খুবই সুস্বাদু এবং এই এলাকায় খুবই জনপ্রিয়।
নারকেল ও সুপারি
নোয়াখালী জেলার মাটি নারকেল ও সুপারি চাষের উপযোগী। তাই প্রাচীনকাল থেকে এই এলাকায় সুপারি ও নারকেলগাছের আধিক্য দেখা যায়। সমগ্র নোয়াখালী জেলা নারকেল-সুপারির জন্য দেশব্যাপী বিখ্যাত।
বিএসডি/আইপি