নিজস্ব প্রতিবেদক:
মিন্টু ও আজিজকে একসঙ্গেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল। জানাজাও হয়েছিল তাদের একসঙ্গে। শুধু তাই নয়, নিজে গ্রামে পাশাপাশি কবরে শায়িত করা হয়েছে দুই খুনিকে। তবে দুজনকে পাশাপাশি কবরে রাখতেই শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। এতে দাফনকাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
মঙ্গলবার সকালে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার রায়লক্ষ্মীপুরে নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। তাদের জানাজায় অনেকেই অংশ নেন। আশপাশের গ্রামের অনেকে জানাজায় অংশ নিতে না পারলেও সকাল না হতেই তাদের কবর দেখতে ছুটে আসেন। দুজনের কবর দেখতে নারীরাও ছুটে এসেছেন।
২০০৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রায়লক্ষ্মীপুর গ্রামের মাঠে আলমডাঙ্গা উপজেলার জোড়গাছা গ্রামের কমেলা খাতুন ও তার বান্ধবী ফিঙ্গে বেগমকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলায় সোমবার রাতে একই উপজেলার রায় লক্ষ্মীপুর গ্রামে লক্ষ্মীপুর গ্রামের আজিজ ওরফে আজিজুল ও একই গ্রামের মিন্টু ওরফে কালুর ফাঁসি কার্যকর হয়।
অন্য সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ১২টার দিকে দুজনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আলাদা আলাদা অ্যাম্বুলেন্সে পুলিশ প্রহরায় দুজনের মরদেহ নিয়ে রওনা দেন স্বজনরা।
রাত আড়াইটার দিকে তারা আলমডাঙ্গার নিজ গ্রাম রায়লক্ষ্মীপুর পৌঁছান। আজিজুল ও মিন্টুর দাফনের জন্য গ্রামের মসজিদে নির্ধারিত সময়য়ের ১০ মিনিটেই আগেই ফজরের জামাত হয়ে যায়। এরপর মসজিদের সামনের ফাঁকা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। আজিজ ও মিন্টুর মরদেহ সামনে রেখে একই সঙ্গে জানাজা পড়ানো হয়।
গ্রামের অনেকেই জানান, জানাজায় ইমামতি করেন আজিজুলের মামাতো ভাই ঝিনাইদহের সাধুহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের কবরস্থানের পাশাপাশি কবরে তাদের দাফন করা হয়।
স্থানীয় খাসকররা ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান রুন্নু জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মরদেহ কবরে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। এ কারণে দাফনকাজে কিছুটা বিলম্ব ও বিঘ্ন ঘটে।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খান বলেন, চুয়াডাঙ্গার আলোচিত ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দণ্ডপ্রাপ্ত দুজনের ফাঁসি কার্যকরের জন্য কয়েক দিন আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি নেই। শনিবার যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে শেষবারের মতো স্বজনরা তাদের সঙ্গে দেখা করেন। দুই পরিবারের অর্ধশতাধিক মানুষের সঙ্গে দেখা করাই ছিল তাদের দুজনের শেষ ইচ্ছা। এছাড়া তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী শনিবার গরুর কলিজা ও ইলিশ মাছ খাওয়ানো হয়। রোববার গ্রিল ও নান রুটি আর সোমবার মুরগির মাংস, দই আর মিষ্টি খাওয়ানো হয়।
এদিকে, দুই খুনির ফাঁসি কার্যকর করার জন্য কারাগারের নিরাপত্তায় সন্ধ্যার পর থেকেই গোটা এলাকায় পুলিশ ও র্যাবের নজরদারি বাড়ানো হয়। কারাগারে দায়িত্বে ছিলেন ১৩ জন অস্ত্রধারী কারারক্ষী। এছাড়া পুলিশ ও র্যাবের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন কারাগারের প্রধান ফটকে।
কারাসূত্রে জানা গেছে, দুই খুনির ফাঁসি কার্যকরে রাতে একে একে কারাগারে ঢোকেন যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, সিভিল সার্জন দিলীপ শেখ আবু শাহীন ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সায়েমুজ্জামান। রাতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ওই দুই আসামিকে গোসল করানোর পর তাদের তওবা পড়ান কারা মসজিদের ইমাম। রাতেই স্বজনদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পর তাদের খাবার খাওয়ানো হয়।
এরপর তাদের রায় পড়ে শোনানো হয়। নিম্ন আদালতের রায়, আপিল এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমার আবেদন নামঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি তাদের জানানো হয়। পরে তাদের জমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নেয়া হয়। সোমবার রাত পৌনে ১১টায় প্রথমে মিন্টু ওরফে কালু এবং এর পাঁচ মিনিট পর একই গ্রামের আজিজ ওরফে আজিজুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ফাঁসি কার্যকরে জল্লাদ কেতু কামার, মশিয়ার রহমান, লিটু হোসেন, আজিজুর রহমান ও কাদের অংশ নেন। ফাঁসি কার্যকরের পর সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে চিকিৎসক টিম তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর ফরেনসিক টিম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার পর মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে সন্ধ্যায় আলমডাঙ্গার খাসকররা ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান রুন্নুর নেতৃত্বে মিন্টু ও আজিজুলের পরিবারের সাতজন সদস্য তাদের মরদেহ নিতে কারাগারে আসেন।
এ সময় তাদের দুজনের জন্য দুটি অ্যাম্বুলেন্স সঙ্গে ছিল। ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পরিবারের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের সময় কালু ও আজিজ সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে কাঁদতে থাকেন। মরদেহ রাতেই বাড়িতে পৌঁছানোর সময় স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে এলাকার বাতাস। পরে সকাল ৬টায় দাফন সম্পন্ন করা হয়।
২০০৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আলমডাঙ্গা উপজেলার জোড়গাছা গ্রামের কামেলা খাতুন ও তার বান্ধবী ফিঙ্গে বেগমকে রায়লক্ষ্মীপুর গ্রামের মাঠে হত্যা করা হয়। তারা দুজন বান্ধবী ছিলেন। হত্যার আগে তাদের দুজনকে ধর্ষণ করা হয় বলে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধের পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে ওই দুই নারীর গলা কাটা হয়। এ ঘটনায় পরদিন আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত এক নারীর মেয়ে। মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ওই দুজনসহ চারজনকে আসামি করা হয়। অপর দুজন হলেন- একই গ্রামের সুজন ও মহি। মামলা বিচারাধীন অবস্থায় আসামি মহি মারা যান।
২০০৭ সালের ২৬ জুলাই এ মামলায় সুজন, আজিজ ও কালুকে মৃত্যুদণ্ড দেয় চুয়াডাঙ্গার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। এরপর আসামিপক্ষের লোকজন হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১২ সালে ১১ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার আদেশ দেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ দুই আসামির রায় বহাল রাখেন এবং অপর আসামি সুজনকে বেকসুর খালাস দেন। ২০ জুলাই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান খালাসপ্রাপ্ত সুজন। পরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আজিজ ও কালু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান। কিন্তু তা নামঞ্জুর হয়।
বিএসডি /আইপি