নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ও সংক্রমণের পূর্বাভাস সম্পর্কে ধারণা দেবে ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন নজরদারি ব্যবস্থা। একইসঙ্গে এ ব্যবস্থা কমিউনিটিতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের আগাম উপস্থিতি নির্ণয়, ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে ও হটস্পট সম্পর্কে ধারণা দিতে এবং প্রবাহমান ভাইরাসের ধরন এবং প্রকরণ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।
মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (আইইডিসিআর’বি) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, নতুন এ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা পয়ঃনিষ্কাশনের পানিতে সার্স-কোভ-২ এর আরএনএ শনাক্ত করার মাধ্যমে করোনার গতিবিধি সফলভাবে অনুসরণ করতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নালা-নর্দমার নজরদারি পদ্ধতি সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের জুন মাসে চালু করা হয়, যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আটটি ওয়ার্ডের ৩৩টি এলাকা অন্তর্গত ছিল এবং প্রাথমিকভাবে তা পোলিও ভাইরাস (সাবিন ভ্যাকসিন স্ট্রেইন), অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স জিন এবং অন্যান্য আন্ত্রীক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু শনাক্ত করতে সক্ষম ছিল।
এর আগে মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে আইসিডিডিআর,বি, ইউএসএর ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া, ইউকের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান একটি আলোচনা সভার মাধ্যমে সর্বপ্রথম সম্মিলিতভাবে ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় সার্স-কোভ-২ এর নজরদারি পদ্ধতি উপস্থাপন করে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাৎক্ষণিকভাবে এ পয়ঃনিষ্কাশন নজরদারি পদ্ধতির পরিধি নমুনায় সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের শনাক্ত করার জন্য প্রসারিত করা হয়েছিল।
তারপর থেকে প্রতিটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে সাপ্তাহিকভাবে নির্দিষ্ট পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার স্থানে নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং তাতে ভাইরাসের পরিমাণ রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন কোয়ানটিটেটিভ পিসিআর নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিমাপ করা হয়। প্রতিটি নমুনা সংগ্রহের স্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত এ ভাইরাসের পরিমাণ ওই এলাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং ড্রেন লাইনের তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয় এবং এভাবে ওই এলাকায় সংক্রমিত লোকের সংখ্যা দেওয়া হয়। অবশেষে এসব তথ্য এবং বিশ্লেষণ একটি লিঙ্কে একটি অনলাইন ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, এ নজরদারি ব্যবস্থা একটি প্রাথমিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে, যা করোনা সংক্রমণের বৃদ্ধি বা হ্রাসের আগেই জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এ সংক্রমণের বৃদ্ধির বা হ্রাসের প্রবণতা অনুমান করতে সহায়তা করে। এর ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কোন অঞ্চলে করোনার প্রকোপ বেশি তা ধারণা করতে পারেন এবং সীমিত পরীক্ষার সংস্থানগুলো সেই অঞ্চলগুলোতে আরও বেশি বরাদ্দ করে সংক্রমণ রোধ করতে পারেন। এছাড়াও তারা একটি সুনির্দিষ্ট এলাকার জন্য সুনির্দিষ্ট জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং ওই সম্প্রদায়ের নাগরিকদের যতটা সম্ভব নিরাপদ রাখতে পারেন।
অনুষ্ঠানে আইসিসিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. রাশিদুল হক বলেন, বর্তমানে শুধুমাত্র উপসর্গযুক্ত অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা নেওয়ার সময় কোভিড-১৯ এর রোগ নির্ণয় করা হয়। কিন্তু অনেক অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসা করান না এবং অনেকে আছেন যারা উপসর্গবিহীন। এভাবে কর্তৃপক্ষ প্রায়শই সংক্রমিত ব্যক্তির মোট সংখ্যা সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত থাকেন না, যার ফলে সম্প্রদায়ের করোনার সংক্রমণ অবমূল্যায়িত হয়।
তিনি বলেন, আমাদের মতো সক্রিয় নজরদারি ব্যবস্থা এসব অসুস্থ ব্যক্তিদের কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে না এবং এটি করোনার মতো সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবকে আরও কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।
সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য শাখা) সৈয়দ মজিবুল হক বলেন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে এ ধরনের গবেষণা বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে ফলাফলগুলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হতে পারি এবং বিশ্বকে দেখাতে পারি যে আমরা কীভাবে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে নজরদারি করতে পারি। আমাদের তৃণমূল পর্যায়ে ফলাফল প্রচার করতে হবে যাতে আমরা মানুষের আচরণ পরিবর্তন করতে পারি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের গবেষণা প্রয়োজন। যেহেতু কোভিড-১৯ মহামারি হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাই আমাদের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে এমন উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এটি অবশ্যই সচেতনতা তৈরিতে অবদান রাখবে এবং গবেষণার ফলাফলগুলো কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কাজ এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী নীতি এবং কার্যক্রমগুলোতে অনুবাদ করা যেতে পারে।
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মামি তানিউচি উদীয়মান স্ট্রেন এবং রূপগুলো শনাক্ত করার সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেছেন, আমরা সার্স-কোভ-২ এর সঞ্চালনকারী স্ট্রেন এবং রূপগুলি ট্র্যাক করার জন্য একটি শক্তিশালী সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করছি। আমরা কাজ শুরু করেছি এবং বর্তমানে তথ্য বিশ্লেষণ করছি। আশা করি, এ অন্তর্দৃষ্টিগুলো সংক্রমণের পরিবর্তনগুলোকে আরও সঠিকভাবে শনাক্ত করতে এবং কোভিড-১৯-এর জন্য জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং নজরদারি জোরদার করতে সহায়তা করবে।
ঢাকায় পয়ঃনিষ্কাশন পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনার বিষয়ে মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি শিগগিরই যেকোনো সময় শেষ হচ্ছে না, আমাদের এটির থেকে এগিয়ে থাকতে হবে প্রস্তুতির মাধ্যমে এবং এভাবে দ্রুত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধ করতে হবে। যেহেতু উপসর্গহীন রোগীর সংখ্যা উপসর্গবিশিষ্ট রোগীর চেয়ে বেশি, তাই এ ধরনের নজরদারি ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকারের জন্য সত্যিই উপযোগী। আমরা যদি আরও বিশ্লেষণ করতে পারি এবং পুরো ঢাকা শহরে নজরদারি ব্যবস্থা বাড়াতে পারি তাহলে এটি খুবই কার্যকর বিষয় হবে।
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, সরকারের প্রচেষ্টার কারণে বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে বেশ ভালো কাজ করেছে। কোভিড-১৯ নিয়ে বাংলাদেশে যে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী গবেষণা হচ্ছে তাও সরকারের প্রচেষ্টায় সহায়তা করছে। এ ধরনের নজরদারি ব্যবস্থা হলো গবেষণার একটি উদাহরণ, যা কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, আশা করা যায় ড্যাশবোর্ড এবং ঢাকায় পয়ঃনিষ্কাশন নজরদারির পরীক্ষামূলক গবেষণা কার্যক্রম প্রমাণ করবে যে অধিক জনবহুল দেশগুলোতে সার্স-কোভ-২ এর সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরা সম্ভব এবং এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোভিড-১৯ এর যথাযথ উপস্থাপনা বাড়ানোর প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে।
পয়ঃনিষ্কাশন নজরদারি গবেষণাটি বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত হয়।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অভিজ্ঞ জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা; স্বাস্থ্য অধিদফতর; আইইডিসিআর; ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া, ইউএসএ; ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, ইউকে; এবং আইসিডিডিআর,বির প্রতিনিধিরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
বিএসডি/ এলএল