চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় শেয়ারবাজার, জমি-ফ্ল্যাট, ব্যাংক-সঞ্চয়পত্রে রাখা টাকা ও নগদ টাকা—সব ধরনের অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এমন ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সাম্প্রতিক সময়ে দেওয়া হয়নি। শুধু তা–ই নয়, কালোটাকা সাদা করলে এনবিআর ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না—এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়। আর এই সুযোগেই কালোটাকা সাদা করার এই মহোৎসব। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে বিদেশ সংযোগ অনেক কমে গেছে। সুযোগ কমে গেছে অর্থ পাচারের। আর এ কারণে দেশের মধ্যে কালোটাকা সাদা হচ্ছে বেশি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক, নৈতিকতা পরিপন্থী ও দুর্নীতি সহায়ক। তিনি বলেন, এবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অন্যবারের চেয়ে বেশি বিস্তৃত। অবৈধ লেনদেন বেশির ভাগই নগদ টাকায় হয়। বিশেষ করে করোনার সময়ে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে। ওই লেনদেনের কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন তাঁরা।
কত টাকা সাদা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে শেয়ারবাজার, নগদ টাকা কিংবা জমি-ফ্ল্যাট কিনে সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৯৩৪ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। তাঁদের মধ্যে জমি-ফ্ল্যাট কিনে কিংবা নগদ টাকা সাদা করেছেন ৯ হাজার ৬২৩ জন। চলতি বছরে এনবিআরে জমা দেওয়া বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে কালোটাকার কথা জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি ব্যাংকে রাখা বিভিন্ন আমানত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা নগদ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এনবিআর রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি নগদ বা ব্যাংক-সঞ্চয়পত্রে গচ্ছিত টাকা ঘোষণায় এসেছে। এত দিন এই বিপুল পরিমাণ টাকা তাঁরা তাঁদের কর নথি দেখাননি। নগদ টাকা সাদা করার সুযোগ থাকায় এবার ফ্ল্যাট বা জমি কিনে টাকা সাদা করার প্রবণতা একদম কম।
মন্দা শেয়ারবাজারে চাঙা করতে শেয়ার কিনে এক বছর ‘লক ইন’ বা বিক্রি নিষেধাজ্ঞার শর্ত দিয়ে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। করহার ধরা হয় ১০ শতাংশ। মাত্র ৩১১ জন বিনিয়োগকারী এই সুযোগ নিয়েছেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন মাত্র ৪৩০ কোটি টাকা।
চিকিৎসকেরা বেশি সাদা করেছেন
এনবিআরের তথ্য–উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন ঢাকার কর অঞ্চল-১০–এর করদাতারা। এই কর অঞ্চলের ৬১০ জন করদাতা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা সাদা করেছেন। তাঁদের প্রায় শতভাগই চিকিৎসক, তাঁরা নগদ বা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা সাদা করেছেন। জানা গেছে, এই কর অঞ্চলে রাজধানীর প্রায় ২৫ হাজার চিকিৎসক নিবন্ধিত। কর অঞ্চলটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মাধ্যমে উপার্জিত পুরো টাকা বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে দেখান না। তাঁরা এবার সেই সুযোগ নিয়েছেন।
কর অঞ্চল-১০ কমিশনার লুৎফুল আজীম এ বিষয়ে বলেন, ‘চিকিৎসকদের অনেকেই ক্লিনিকে রোগী দেখা, পরামর্শক সম্মানীসহ বৈধভাবে টাকা উপার্জন করেছেন। কিন্তু এত দিন আয়কর বিবরণীতে দেখাননি। এবার আমরা এমন অনেক চিকিৎসককে এই অর্থ ঘোষণা দেওয়ার জন্য নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছি। এর ফলে এই কর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি করদাতা অপ্রদর্শিত অর্থ ঘোষণায় এনেছেন।’
দ্বিতীয় স্থানে আছে কর অঞ্চল-১। এই কর অঞ্চলের ৪৭৮ জন করদাতা কালোটাকা সাদা করেছেন। এই কর অঞ্চলে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা বেশি। এ ছাড়া ঠিকাদারেরাও আছেন। এই কর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি—প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে।
টাকা সাদা করায় তৃতীয় স্থানে আছেন কর অঞ্চল-২–এর করদাতারা। এই কর অঞ্চলের ৪১২ জন করদাতা টাকা সাদা করেছেন। ইসলামপুরসহ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এই কর অঞ্চলের করদাতা।
তাহলে দেশের বড় করদাতারা কি কালোটাকার মালিক নন? তাঁরাও টাকা সাদা করায় শামিল হয়েছেন। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) ৭০৬ জন বড় করদাতা নিবন্ধিত। তাঁরা বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যাংক-বিমার পরিচালক। তাঁদের মধ্যে এবার ২৬ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। এই ২৬ জন প্রায় ৮৪ কোটি টাকা কর দিয়েছেন। প্রত্যেকে কালোটাকা সাদা করে গড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি কর দিয়েছেন। তাঁদের যদি সবাই নগদ বা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা সাদা করেন, তাহলে প্রত্যেকে গড়ে ৩০ কোটি টাকা করে সাদা করেছেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিনটি কর অঞ্চল থেকে ৮৪৭ জন করদাতা এই সুযোগ নিয়েছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে সবচেয়ে বেশি—৫৩৮ জন কুমিল্লার করদাতা কালোটাকা সাদা করেছেন।
সুযোগ নিয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা
আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার ঝোঁক বেশি। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সারা দেশ থেকে মাত্র ৩১১ জন করদাতা কালোটাকায় শেয়ার কিনেছেন। তাঁদের মধ্যে ১০৯ জন ঢাকার কর অঞ্চল-৫–এর করদাতা। এই কর অঞ্চলে দেশের আবাসন ব্যবসায়ীরা নিবন্ধিত। জানা গেছে, নিবন্ধন ফির টাকা কমানোর জন্য ফ্ল্যাটের দাম কম দেখানো হয়। বাকি টাকা অন্য কোনো উপায়ে আবাসন ব্যবসায়ীকে পরিশোধ করা হয়। কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ী ওই টাকা নিজের আয়কর বিবরণীতে দেখাতে পারেন না। তাঁরা এখন সেই টাকা শেয়ারবাজারে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে এলটিইউর মাত্র একজন বড় ব্যবসায়ী ৩ লাখ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে বৈধ করেছেন।
ঢাকার কর অঞ্চল-৪–এর ৩০ জন করদাতা নিজেদের কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এই কর অঞ্চলে তৈরি পোশাক মালিক, জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা নিবন্ধিত। এ ছাড়া সিলেটের ৩০ জন ব্যক্তি শেয়ারবাজরে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করেছেন।
এখনো সুযোগ আছে
আগামী জুন পর্যন্ত ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করা যাবে। এ জন্য করদাতাকে আবারও সংশোধিত রিটার্ন দিতে হবে। কারণ, রিটার্ন জমার মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেছে। আর কালোটাকায় এলাকাভেদে নির্ধারিত কর দিয়ে জমি-ফ্ল্যাট কিনলে আগামী বছর রিটার্নে তা দেখাতে হবে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে তা এক মাসের মধ্যে এনবিআরের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতে হবে। আগামী বছরের রিটার্নে এই বিনিয়োগের কথা জানাতে হবে।
প্রায় সব সরকারের আমলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো এ দেশের করদাতাদের সামনে এ ধরনের সুযোগ আসে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে ১৭ বার এই সুযোগ পেয়েছেন করদাতারা। কিন্তু কালোটাকার মালিকেরা তেমন সাড়া দেননি। সবচেয়ে বেশি সাড়া মিলেছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তবে সাদা হয়েছিল ৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।
এ বছর তুলনামূলক বেশি কালোটাকা সাদা করার কয়েকটি কারণ আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর বিদেশে যাওয়া-আসা বন্ধ থাকার কারণে টাকা পাচারে সুযোগ কমে গেছে। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে গেছে। অন্যদিকে এবার টাকা সাদা করার সুযোগের আওতাও বাড়ানো হয়েছে। জমি-ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে যেমন টাকা সাদা করা যাচ্ছে, তেমনি ব্যাংকে রাখা বা নগদ টাকাও সাদা করা সম্ভব। এসব কারণে কালোটাকা সাদা বেশি হয়েছে।’