ফিচার ডেস্ক-
করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রামক ধরন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট গতবছর ভারতে প্রথম শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাসের যত ধরন পাওয়া গেছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি সংক্রামক ও মারাত্মক।
বর্তমানে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে এবং সারা বিশ্বে এই ভ্যারিয়েন্টটিই সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত করছে। এ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। করোনাভাইরাসের ভয়ংকর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষিত থাকতে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ এখানে তুলে ধরা হলো।
করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ও অন্যান্য ধরন থেকে সুরক্ষা পেতে বিশেষজ্ঞদের প্রধান পরামর্শ হলো, টিকা নিন। কিন্তু অনেকেরই করোনার টিকার প্রতি অনীহা রয়েছে। কারণ তারা জেনেছেন যে, টিকা নেওয়ার পরও কেউ কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার করোনার টিকার মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়া গুজবও কিছু মানুষকে টিকা গ্রহণে অনুৎসাহী করে তুলেছে। কিন্তু বাস্তব বিশ্বের উপাত্ত বলছে যে, করোনার টিকা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা দিতে পারে।
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইজারের করোনার টিকার প্রথম ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গযুক্ত সংক্রমণের বিরুদ্ধে ৩৩ শতাংশ কার্যকর। দ্বিতীয় ডোজ নিলে কার্যকারিতা ৮৮ শতাংশে পৌঁছে। যারা ফাইজারের করোনার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হয়েছেন তাদের ৯৪ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। যারা দ্বিতীয় ডোজও নিয়েছেন তাদের ৯৬ শতাংশেরই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি। তার মানে হলো, টিকা নিয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে দুর্বল করা যাচ্ছে। ফাইজারের মতো মডার্নার করোনার টিকাতেও একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই মডার্নার টিকাও প্রায় অনুরূপ সুরক্ষা দিতে পারে।
তবে স্বাস্থ্য সমস্যা বা অন্য কারণে যারা করোনার টিকা নিতে পারছেন না, তাদেরকে বিশেষ সচেতন থাকতে হবে। অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ও মাস্ক পরতে হবে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শরীরে পূর্ব থেকে জটিল রোগ থাকলে করোনাভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। যাদের ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা করোনার টিকা নিলেও বাড়তি সচেতনতার প্রয়োজন আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে টিকা গ্রহণে শক্তিশালী সুরক্ষা না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- তাই নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে ও উপসর্গ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব কোভিড টেস্ট করতে হবে। যারা নিজেদেরকে স্বাস্থ্যবান মনে করেন তাদেরও টিকা নেওয়ার পর বেপরোয়া চলাফেরা করা উচিত নয়। তাদেরকেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, কারণ একটা চলমান মহামারিতে কেউ ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
আমরা যা খাই তা আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্য ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে থাকে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা পেতে আমাদেরকে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে ও অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করতে হবে। কম কার্বোহাইড্রেটের খাবার খান, এতে উচ্চ রক্ত শর্করা ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট কমালে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে। শরীরের গঠন ঠিক রাখতে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। নিয়মিত শাকসবজি ও ফল খাওয়ার চেষ্টা করুন, বিশেষত বিটা ক্যারোটিন ও অ্যাসকরবিক অ্যাসিড (ভিটামিন সি) রয়েছে এমন খাবার। মাশরুম, টমেটো, ক্যাপসিকাম ও পালংশাকের মতো শাকসবজি শরীরকে সংক্রমণ থেকে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে সাহায্য করে।
খাদ্যতালিকায় ওমেগা ৩ ও ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার রাখুন, অন্যথায় এসবের সাপ্লিমেন্ট সেবন করতে পারেন। খাবারে আদা ও হলুদের ব্যবহার বাড়িয়ে দিন। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, আদা ও হলুদ সংক্রমণকে দমিয়ে রাখতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শে আদা ও হলুদের সাপ্লিমেন্টও ব্যবহার করতে পারেন। তুলসি পাতা ও কালো জিরাও রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা যোগাতে পারে। শরীরকে সুস্থ রাখতে বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার খেতে পারেন। ফ্ল্যাক্স সীড, মিষ্টি কুমড়ার বীজ ও বাদামে প্রচুর প্রোটিন ও ভিটামিন ই পাবেন।
খাদ্যতালিকায় জিংক সমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন। মিনারেলটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে- যাদের খাদ্যতালিকায় জিংক সমৃদ্ধ খাবার ছিল না তাদের ফ্লু, কোল্ড ও অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণের প্রবণতা বেশি ছিল। একটি ল্যাব টেস্ট আশাপ্রদ করেছে, জিংক ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরিতে বাধা দিতে পারে। জিংক ট্যাবলেটও সেবন করতে পারেন। বয়স্কদের জন্য এ পরামর্শ বেশি প্রযোজ্য।
সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা অবহেলা করি এমন একটি খাবার হলো, দইয়ের মতো প্রোবায়োটিক। অথচ কেবল তরুণ নয়, বয়স্করাও প্রোবায়োটিক খেয়ে উপকার পাবেন। চলমান মহামারিতে একজন মানুষের খাদ্যতালিকা কেমন হবে তা তার স্বাস্থ্যাবস্থার ওপর নির্ভর করে। ঝুঁকি এড়াতে ও সর্বোচ্চ উপকারিতা পেতে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলে খাদ্যতালিকা প্রণয়ন করুন।
শরীরে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ দমনের ক্ষমতা বজায় রাখার অন্যতম উপায় হলো প্রতিরাতে ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমানো। ঘুমের অভাবে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মস্তিষ্কের কার্যক্রম ব্যাহত হয় ও ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা কমে যায়। ঘুমের ঘাটতিতে শরীরের বিভিন্ন অংশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়, এমনকি টিকার কার্যকারিতাও কমাতে পারে।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন। দিনে ৮/১০ গ্লাস পানি যেন শরীরে যায়। পানি শরীর থেকে দূষিত পদার্থ দূর করে ও গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক কার্যক্রম সচল রাখে। শরীরে পর্যাপ্ত পানি থাকলে ভাইরাসের সক্রমণে সহজে কাবু হয় না। সাধারণ পানির পাশাপাশি সাইট্রাস ফলের রস ও ডাবের পানি পান করলে শরীর আরো তেজি হবে।
কেবল ভালো ভালো খাবার খেলে হবে না, রুটিন মেনে শরীরচর্চাও করতে হবে। এমনকি হালকা শরীরচর্চাতেও বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়। নিষ্ক্রিয় শরীরকে কেবল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নয়, যেকোনো ভাইরাসই শক্তিশালী আক্রমণ করতে পারে। নিয়মিত শরীরচর্চা করলে বিপাকের উন্নতি হয়, যা সরাসরি ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। স্ট্যামিনার ভিত্তিতে ৩০/৪৫ মিনিট শরীরচর্চা করতে পারেন।
নিজেকে যথাসম্ভব মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। যদিও দীর্ঘকালের মহামারিতে এটা কঠিন, কিন্তু ইমিউন সিস্টেমের কথা ভেবে মনে শৈথিল্যায়নের চেষ্টা করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা জানান, অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তায় ইমিউন সিস্টেম নিষ্পেষিত হয়। নিষ্পেষিত ইমিউন সিস্টেম ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়ংকর সংক্রমণকে রুখে দিতে ব্যর্থ হতে পারে। দুশ্চিন্তা কমাতে নিয়মিত ধ্যান, প্রার্থনা ও পরিচিতজনের সঙ্গে কথা বলুন। একাকীত্বে বিষণ্নতা বাড়ে। তাই নিরাপদ দূরত্বে প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করুন। ফোনে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর নিতে পারেন। প্রয়োজনে থেরাপিস্টের পরামর্শ নিন।
আপনার ত্বক ফর্সা হলে প্রতিদিন ১৫/২০ মিনিট রোদ পোহান, ত্বক শ্যামলা বা কালো হলে ২৫/৪০ মিনিট। এতে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হবে। গবেষণা বলছে, ভিটামিন ডি শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট সেবন করে ইমিউন রেসপন্স বাড়াতে পারেন।
বিএসডি/এমএম