দীর্ঘদিন ধরে বাসচালকের সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করতেন মো. সনয়। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। গত ১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে বাস নিয়ে নেত্রকোনায় ফিরছিলেন তিনি। কেন্দুয়ায় একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
শুধু সনয় নন, দেশে প্রতিবছরই দুর্ঘটনায় মারা যান অনেক পরিবহনশ্রমিক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছেন পরিবহন খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা। ২০২০ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭২৯ শ্রমিক। এর মধ্যে পরিবহন খাতেরই ৩৪৮ জন।
১০ জানুয়ারি প্রকাশিত বিলসের প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সাল বাদে আগের বছরগুলোয় পরিবহন খাতের কর্মীদের মৃত্যুর এ সংখ্যা ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে মারা যান ৫১৬ পরিবহনশ্রমিক। আর ২০১৮ সালে ৪২৪ জন এবং ২০১৭ সালে ২৪৯ পরিবহনশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তাদের হিসাবে, ২০২০ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ১ হাজার ৭৪৫ জনই পরিবহনচালক ও শ্রমিক।
সড়ক খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসাবে, দেশে পরিবহন চালনায় যুক্ত আছেন প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক। সারা দেশে নিবন্ধিত পরিবহনশ্রমিক সংগঠন আছে ২৪৯টি। ৬৪টি জেলা এবং বড় শহরগুলোর টার্মিনালে মালিকদের সমিতি আছে। এ ছাড়া বড় বড় পরিবহন কোম্পানিও মালিক সমিতির সদস্য। কোনো কোনো জেলায় মালিক-শ্রমিকদের একাধিক কমিটি বিদ্যমান। এসব কমিটি অনেক জায়গায় চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ আছে। এর বাইরে ফেরিঘাট, টোলপ্লাজাসহ আরও অঘোষিত বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি হয়। মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণে সব মিলিয়ে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা আদায় হয়। কিন্তু আহত ও নিহত হলে শ্রমিকের পরিবার কারও কাছ থেকেই তেমন সহায়তা পায় না। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে গত বছর দুই মাস এবং এবার প্রায় এক মাস যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ আছে। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহনশ্রমিকেরা। তাঁদের সহায়তায়ও বিশেষভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না।
সড়ক পরিবহন ও শ্রম আইনে শ্রমিকের নিয়োগপত্র থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশে পরিবহন খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের ৯৯ শতাংশেরই নিয়োগপত্র নেই বলে শ্রমিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে। এ জন্য তাঁরা আহত ও নিহত হলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ পান না।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, মালিকেরা নিয়োগপত্র দেন না। সরকারও মালিকদের বাধ্য করে না। ফলে শ্রমিক আহত-নিহত হলে মালিকদের কাছ থেকে নামমাত্র কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করতেই বেগ পেতে হয়। শ্রমিক সংগঠনের চাঁদা থেকে শ্রমিকদের দুঃসময়ে সহায়তা না করার বিষয়ে তিনি দাবি করেন, তাঁরা যথাসাধ্য সহায়তা করার চেষ্টা করেন। তবে সরকার সহায়তা না করলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না।
পরিবহনের পর মৃত্যু বেশি নির্মাণ খাতে
পরিবহনের পর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে এগিয়ে রয়েছে নির্মাণ খাত। বিলসের হিসাবে, গত বছর নির্মাণ খাতের ৮৪ শ্রমিক কাজে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছেন। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৩৪। ২০১৮ ও ২০১৭ সালে ছিল যথাক্রমে ১৬১ জন ও ১৩৪ জন।
এর পাশাপাশি গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কৃষি খাতের ৬৭ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৪৯ দিনমজুর, বিদ্যুৎ খাতের ৩৫, মৎস্য খাতের ২৭, স্টিল খাতের ১৫, নৌপরিবহন খাতের ১৫ জন, মেকানিক ১৪ জন, অভিবাসী শ্রমিক ১৫ জনসহ বিভিন্ন খাতের আরও ৬০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিলস।
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শিরীন আখতার বলেন, কর্মক্ষেত্রে প্রতিবছর অনেক শ্রমিক মারা যাচ্ছেন। ন্যায্য অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অধিকাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ন্যূনতম তোয়াক্কা করে না। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়াতে মালিকদের মানসিকতার পরিবর্তনের পাশাপাশি শ্রমিকদের আরও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
নির্যাতনে ৩১৬ শ্রমিকের মৃত্যু
বিলসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার পাশাপাশি শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গত বছর দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩১৬ শ্রমিক মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও ২২৯ জন। আর ২৪ শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন।
২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে ১ হাজার ২৯২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানিয়েছে বিলস। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৩৩২ এবং আত্মহত্যা করেন ২৬ জন। আর ২০১৮ সালে নির্যাতনে মারা যান ৭৬৪ শ্রমিক। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২৭৯ জন। আত্মহত্যা করেন ৩১ শ্রমিক।
বাংলাদেশের জাতীয় শ্রমিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নইমুল আহসান জুয়েল বলেন, প্রতিনিয়ত শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন ও দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে ও সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যান, তাঁরা আর্থিক ক্ষতিপূরণও পান না। পথে বসছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। শ্রমিকদের দেখার তেমন কেউ নেই। শ্রমিকদের স্বার্থে সরকারি যে উদ্যোগ থাকা দরকার ছিল, তা-ও নেই।