আন্তর্জাতিক ডেস্ক,
রাজধানী কাবুলে প্রেসিডেন্ট প্যা লেস পতনের পর আফগানিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা আবদুল নাসের বুঝে গিয়েছিলেন, মাতৃভূমি ছাড়তে হবে দ্রুত। স্ত্রী জারগোনার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, ৩১ আগস্টের মধ্যেই তারা প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে যাবেন।
গত ২৬ আগস্ট বিকেলে গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়পত্র নিয়ে নাসের পৌঁছে গেলেন বিমানবন্দরে। কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব নিয়মকানুন শেষ করে অপেক্ষায় ছিলেন বিমান উঠবেন।কিন্তু বিধিবাম! বিমানবন্দরের অ্যাবি গেইটের পাশে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হল বোমা। বোমার স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে তিনি এখন কাবুলের একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন।
বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে মেয়ে মুজদা নিকাঞ্জামকে নিয়ে স্ত্রী জারগোনার কাটছে বিনিদ্র প্রহর।জরুরি বিভাগ থেকে একজন চিকিৎসক বেরিয়ে এলেই মুজদা ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন- আমার বাবা কেমন আছেন? আর মা জারগোনা জায়নামাজ থেকেই উঠছেন না।
কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোমা হামলার ঘটনায় শনিবার সকাল পর্যন্ত ১৭৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১০০ জন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা কজন আফগানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স, আল জাজিরা ও সিএনএনের প্রতিবেদকরা।বিমানবন্দরে হামলার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে উঠে এসেছে হৃদয়বিদারক সব গল্প।
আবদুল নাসেরের স্ত্রী জারগোনা বলেন, ‘আফগান গোয়েন্দা সংস্থায় প্রাক্তন সহকর্মীরা অনেক দিন থেকেই বলছিলেন,অন্য দেশে চলে যেতে। শেষে তালেবান যখন সবকিছু দখল করে নিতে শুরু করল, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবার সত্যিই দেশ ছাড়তে হবে। কিন্তু বোমা বিস্ফোরণে সব একদম এলোমেলো হয়ে গেল। আমার স্বামীর বন্ধুরা সেদিন পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারাই গাড়িতে করে নাসেরকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।’
হাসপাতালের করিডোরে তিন দিন ধরে বসে আছেন মা –মেয়ে। কিন্তু একবারের জন্যও নাসেরের কাছে তারা যেতে পারেননি।
মুজদা নিকাঞ্জাম বলেন, ‘আব্বুকে দেখতে দেয়নি ডাক্তার। শুধু একটা ছবি দেখিয়েছে। আব্বুর হাত ও পেটে মারাত্মক জখম’। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরী।
কাবুল বিমানবন্দরে হামলার ঘটনায় আহত হয়েছেন জয়নব হোসেনী। বিস্ফোরণের পর তিনি পড়ে যান পাশের এক নর্দমায়। পরিবারের ১৩ জন সদস্যকে নিয়ে তিনি সেদিন আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি, আমার বাচ্চা আর স্বামী সবাই ভিড়ের ধাক্কায় পাশের এক নর্দমায় পড়ে যাই। হাজারো মানুষ একে অপরের উপর উঠে যাচ্ছিলেন। চারপাশে কী ঘটছে, কারও নজর নেই সেদিকে। সবাই যেদিকে পারছে ছুটছে। আহতদের কান্না, নিহতের স্বজনদের বিলাপে এয়ারপোর্টের পরিবেশ সত্যিই ভারী হয়ে উঠেছিল। আমি পায়ে মারাত্মক আঘাত পেয়েছি। আমার স্বামী বিস্ফোরণ স্থলের অদূরে একটা খাবারের ট্রলি খুঁজে পান। ওটাতে করেই আমাকে হাসপাতাল অবধি নিয়ে এসেছেন আমার বাচ্চারা।’
জয়নব হোসেনী বলেন, ‘সেদিন কাবুল এয়ারপোর্টে যা ঘটেছে, তা স্রেফ উন্মাদনা। যা দেখেছি, এটা ভোলার নয়।’
বিস্ফোরণের পর কিশোর জাভেদ হারিয়ে ফেলেছেন তার বড় বোন নার্গিসকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর নার্গিসের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি।সেদিন রাত থেকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে বোনের ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। শুক্রবার রাতে জাভেদ তার বোনের সন্ধান চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস আপডেট করেছেন।
জাভেদ বলেন, ‘আমি আর আমার বোন একসাথেই ছিলাম। আশা করি আমার বোন এখনও বেঁচে আছে। আমরা নিশ্চয় তাকে খুঁজে পাব।’
গোলাম হাসান তার ১৭ বছর বয়সী ভাতিজাকে নিয়ে এসেছেন একটি হাসপাতালে। বিস্ফোরণে কিশোর মারাত্মক আহত হয়েছেন।
গোলাম হাসান বলেন, ‘আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, একটু চেষ্টা করে দেখা যাক। যদি আমরা দেশ ছাড়তে পারি।’
হাসপাতালের মর্মন্তুদ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখানে এসে কী যে দেখছি! পনেরটি মরদেহ নিয়ে যেতে দেখেছি আমি। কারও হাত,পা নেই তো কারও মাথা নেই। এই দৃশ্য ভুলতে পারছি না।’
আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৭৫ জনে উন্নীত হয়েছে। ওই ঘটনায় অন্তত ১০০ জন আহত হয়েছেন।
কাবুলের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আল জাজিরা এই তথ্য দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে দুইটি শক্তিশালী আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটে।
বৃহস্পতিবারের হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএসআই-এস ও আইএসআই-এসকে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কাবুলে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তালেবানও বলেছে, বিদেশি বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করে তারা যথোপযুক্ত শাস্তি দেবেন।
কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জোড়া আত্মঘাতী বোমা হামলায় অপরাধী ও তাদের উস্কানিদাতাদের বিচারের আওতাওয় আতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।
শুক্রবার পনের সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সন্ত্রাসবাদের এই নিন্দনীয় কাণ্ডের অপরাধী, সংগঠক, অর্থদাতা এবং পৃষ্ঠপোষকদের জবাবদিহি করার এবং তাদের বিচারের আওতায় আনতে জোর দিচ্ছেন।
বোমা হামলার পর আফগানিস্তানের নানগাহার প্রদেশে ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ হামলায় গোষ্ঠীটির একজন সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানাচ্ছেন সেনা কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, নানগাহারে যে ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলাটি চালানো হয়েছে, তার মৃত্যু হয়েছে। এ হামলায় কোন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়নি।
বিএসডি/এএ