নিজস্ব প্রতিবেদক
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গল্প তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে মঙ্গলবার নিউইয়র্কে ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তিনি।
বাংলাদেশের তরুণরাই নতুন বাংলাদেশ গড়বেন বলে আশা প্রকাশ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এ আন্দোলন খুব পরিকল্পিতভাবে চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছুই হঠাৎ করে হয়নি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন ড. ইউনূস। মঙ্গলবার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই বিপ্লব ও এরপরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রের ছবি সংবলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীর্ষক আর্টবুক বিল ক্লিনটনকে উপহার দেন।
অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিল ক্লিনটনের সঙ্গে তার পরিচয় ও সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের গল্প তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন অধ্যাপক ইউনূসকে বাংলাদেশের তরুণ নাগরিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে দায়িত্বগ্রহণকারী নেতা বলে পরিচয় করিয়ে দেন।
বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নিজের প্রথম যোগাযোগের ঘটনা উল্লেখ করে ড. ইউনূস তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন (১৯৮৬ সালে), যা তাকে অবাক করেছিল। আরকানসাসের একজন গভর্নর (সে সময় ক্লিনটন এ অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন) ওই চিঠি পাঠান। চিঠিতে তার সঙ্গে দ্রুত দেখা করতে চান বলে তিনি লিখেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘আমি জানতাম না, তিনি দ্রুত বলতে ঠিক কতটা দ্রুত বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, এরপর আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে আসব, আমি অবশ্যই যাব এবং আপনার সঙ্গে দেখা করব।’’
ড. ইউনূস বলেন, ‘‘তিনি আমাকে বলেছিলেন, এটা (দেখা করা) খুবই জরুরি।’ উত্তরে আমি বলি, ‘আমি দেখছি, কীভাবে দ্রুত আসা যায়। আমি আসব, (তবে) আগেই আসতে পারব না। পরে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। এভাবেই আমাদের যোগাযোগের সূচনা হয়।’’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘শিকাগোতে একটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল। এখন এটি বড় আকারে গ্রামীণ প্রকল্প হয়ে আসছে। আমেরিকায় গ্রামীণ আমেরিকা শুরু হয়েছে। এখানে নিউইয়র্ক সিটিতে, জ্যাকসন হাইটসে। এটি খুবই ছোট এক প্রকল্প ছিল এবং পরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গ্রামীণ আমেরিকার ৩৫টি শাখা রয়েছে। প্রতিটি বড় শহরে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা আছে। এখানে গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহক প্রায় দুই লাখ এবং ঋণগ্রহীতাদের শতভাগ নারী।’’
‘‘এটা তার (বিল) স্বপ্ন ছিল। এখন এসব ব্যাংক থেকে বছরে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়া হয়। আমরা (গ্রামীণ ব্যাংক, আমেরিকা) এখন এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। আমরা বছরে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিই, কোনো জামানত ছাড়া, কোনো কিছু ছাড়া এবং সবাই সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন।’’
তিনি বলেন, ‘‘আগামী ১০ বছরে আমাদের (গ্রামীণ ব্যাংক, আমেরিকা) এই ঋণদানের পরিমাণ বছরে ৪০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এটা দারুণ এক গল্প, যেটা তিনি (বিল) শুরু করেছিলেন। আমরা (বাংলাদেশে) সবে একটি ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছি। ১৯৮৩ সালে আমরা ব্যাংক হিসেবে নিবন্ধিত হই।’’
দেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূস তাদের কথাও বলেন। তিনি তাদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে আসেন। এ সময় মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘দেশ গড়তে, নিজেদের গড়তে যে শব্দে, যে ভাষায় তারা (আন্দোলনকারীরা) কথা বলেছে, তা অসাধারণ। আমি আগে কখনো এভাবে কাউকে কথা বলতে শুনিনি। তারা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ করতে প্রস্তুত। দয়া করে তাদের সাহায্য করুন, সমর্থন করুন। তাদের স্বপ্ন যেন সত্য হয়। আমরা একসঙ্গে এ দায়িত্ব নিতে পারি। এ স্বপ্ন পূরণে আপনি (ক্লিনটন) আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’’
মঞ্চে আসা আন্দোলনকারী তরুণদের প্রশংসা করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘তাদের দেখতে অন্য তরুণদের মতোই মনে হয়। আপনি তাদের আলাদা করে মনে রাখতে পারবেন না। কিন্তু আপনি যখন তাদের কথা শুনবেন, তাদের কাজ দেখবেন, কেঁপে উঠবেন। তারা পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে।’’
অনুষ্ঠানের মঞ্চে ড. ইউনূস তার দীর্ঘদিনের বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেন। এর ফাঁকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তিন ছাত্র নেতাকে সেখানে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রধান উপদেষ্টা তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আব্দুল্লাহকে সরকার পতনের আন্দোলনের কারিগর হিসেবে উল্লেখ করেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘‘গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর মাহফুজ। যদিও মাহফুজ সবসময় বলে, সে একা নয়, আরও অনেকে আছে। সে গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর হিসেবে পরিচিত।’’ মাহফুজকে দেখিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তার কথা শুনলে সারা পৃথিবীর যে কোনো তরুণ অনুপ্রাণিত হবে। তারা নতুন বাংলাদেশ তৈরি করবে। তাদের সফলতার জন্য আপনারা প্রার্থনা করবেন। তাদের জন্য হাত তালি হোক। এ সময় বিল ক্লিনটনসহ সবাই হাততালি দিয়ে সম্মান জানান।
তিনি বলেন, ‘এটি (ছাত্র আন্দোলন) খুব গোছালো ছিল। এমনকি লোকজন জানতেন না, কারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই, আপনি একজনকে ধরে ফেলে বলতে পারবেন না, ঠিক আছে, আন্দোলন শেষ। তারা যেভাবে কথা বলেছেন, তা সারা বিশ্বের তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই।’’