জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে উত্তর আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। খরার কারণে দেশটিতে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেটাকে নজিরবিহীন বলছেন অনেকে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা বলছে, উত্তর কেনিয়ার ওয়াজির কাউন্টি এলাকার একটি গ্রাম বিয়ামাডো। যে গ্রামের রাস্তার দু’ধারে যেন প্রাণীর মৃত্যুর মিছিল চলছে। ধুলোময় রাস্তার দু’পাশে পড়ে আছে প্রাণীর সারি সারি মরদেহ।
প্রচণ্ড রোদের মাঝে পচনশীল প্রাণীদের বিভৎস এই দৃশ্য তৈরি হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে। ফলে ওই এলাকার লোকজন যারা অনেকাংশে গবাদিপশুর ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।
দুর্ভিক্ষের বিষয়ে আগাম সতর্ককারী সংস্থা ফেমিন আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমস নেটওয়ার্কের মতে, গত সেপ্টেম্বর থেকে কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকায় স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা গত কয়েক দশকের মধ্যে স্বল্প বৃষ্টিপাতের সর্বনিম্ন হার।
বৃষ্টিপাত না হওয়ায় চারণভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও পানীয় সংকট। খরার কারণে অ্যাডো তার গবাদিপশুর অর্ধেক ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। আর অবশিষ্ট যা আছে, সেগুলোর অব্স্থা খুবই খারাপ। দুধ দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই এবং রোগাপটকা হওয়ায় বিক্রি করাও দূরূহ।
কমলা রঙয়ের দাড়ি নাড়তে নাড়তে ক্ষোভের সঙ্গে গ্রামের এক জ্যেষ্ঠ বাসিন্দা বলেন, ‘তাদের কেউই চায় না।’ গত চার মাসে দেশটিতে গরুর দাম ব্যাপক পড়ে গেছে। অ্যাডো বলেন, আগে যে গরু ৪০ হাজার কেনিয়ান শিলিংয়ে বিক্রি হতো, এখন তার দাম ৫ হাজারে নেমে এসেছে।
চলতি বছরের শেষের দিকে যদি বৃষ্টির দেখা না মেলে তাহলে বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে এটি হবে টানা তৃতীয় স্বল্প-বৃষ্টিপাতের মৌসুম। ওই সময়ে বর্তমান খরার শুরু হয়েছিল, আগের খরা শেষ হওয়ার মাত্র তিন বছর পর। যা সাধারণ পাঁচ থেকে সাত বছরের খরা চক্রের চেয়েও অনেক আগাম। আর এই সময়কালে চারণভূমি এবং জলাশয়গুলো পুরোপুরি পুনরুত্পাদনের জন্য তৈরি হয় না।
কেনিয়ার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (এনডিএমএ) পরিচালক জেমস ওডুর বলেছেন, বেশি ঘন ঘন এবং দীর্ঘতর খরা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
একমাত্র আশা বৃষ্টি আসবে
গত মাসে জাতিসংঘ বলেছে, তারা প্রত্যাশা করছে ওয়াজিরসহ কেনিয়ার শুষ্ক এবং আধা-শুষ্ক কাউন্টিগুলোর প্রায় ২৪ লাখ মানুষকে খাবার পেতে চরম সংগ্রাম করতে হবে। যদিও এই সংখ্যা গত ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৪ লাখ।
খাবারের সন্ধানে চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আসাদের একজন জিনাব কুলে। ২৫ বছর বয়সী এই নারী বর্তমানে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এর মধ্যে গত চার মাস তিনি এবং তার এক ও দুই বছর বয়সী দুই ছেলে শুধুমাত্র ভূট্টা খেয়েছে। ছোট দুই শিশু ডায়রিয়ায় ভুগছে।
পাঁচ বছরের নিচে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অন্যতম সাধারণ এক উপসর্গ এই ডায়রিয়া। তারা সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কুলের শঙ্কা তার ছোট সন্তান ফ্লুতে দুর্বল হয়ে উঠছে। সেখানে ৪ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি শিশু, ৯৩ হাজার অন্তঃসত্ত্বা এবং স্তন্যদানকারী নারী খরার এই সময়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে ইতোমধ্যে তীব্র পুষ্টিহীনতা শুরু হয়েছে।
বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানির হাহাকার তৈরি হয়েছে কেনিয়ায়। সাধারণত গৃহস্থলীর কাজের জন্য ঐতিহ্যগতভাবেই নারীরা পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু বৃষ্টির দেখা না মেলায় পানির জন্য তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটাপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওয়াজির কাউন্টির স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক সোমো দাহির।
কেনিয়ার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলছে, গত অক্টোবরে কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় কাউন্টিতে পানির সন্ধানে গড়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথের দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়েছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, আফ্রিকা অঞ্চলে ২০২০ সাল ছিল এ যাবৎকালের রেকর্ড তৃতীয় সর্বাধিক উষ্ণতম বছর। ২০৫০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলের তাপমাত্রা আড়াই ডিগ্রির বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রত্যেকটি বৃদ্ধির ঘটনায় চরম আবহাওয়ার পরিবর্তন বড় হয়ে ওঠে।
নিজের পাঁচটি গরু ইতোমধ্যে খরার কারণে খাবারের অভাবে মারা গেছে জানিয়ে পাঁচ আঙুল দেখিয়ে গিধায়েস নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘যদি বৃষ্টি না আসে, আমাদের প্রাণীকূল মারা যাবে, তখন আমরা সবাই মারা যাবো।’