হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি পেতে আদালতে যাওয়ার সরকারি পরামর্শকে আমলে নিচ্ছে না বিএনপি। দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মনে করছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর ধারার ক্ষমতাবলে শর্তযুক্তভাবে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রেখে যেভাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছে— সেই আইনে তাকে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। ফলে, যেভাবে আদালতে যাওয়ার পথ দেখাচ্ছে সরকার, তা একেবারেই রাজনৈতিক কৌশলগত প্রচার বলে দাবি করেন বিএনপির নেতারা। এ কারণে নতুন করে আদালতে যাওয়ার কোনও কারণ নেই বলেও জানান তারা।
খালেদা জিয়ার আইনি বিষয় দেখভাল করেন— এমন একাধিক বিএনপি নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকার খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও তার বিদেশে চিকিৎসা করানোর বিষয়ে আইনি বিষয় নিয়ে যেভাবে প্রচার চালাচ্ছে, তা ‘গোয়েবলসীয়’ প্রচারণার মতো।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, প্রথম বিষয় হচ্ছে— আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে মানবিক আবেদন করতে হলে প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে করতে হবে। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে মতামত চাইতে পারে। খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও তিনি আজকে মুক্ত ও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা পাচ্ছেন। সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে পাচ্ছেন। তারপরও তারা আবেদন করলে দেখা যাবে।’
এই ঘটনার পর রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এক প্রতিক্রিয়ায় জানান, ৪ সেপ্টেম্বর বেগম জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার আবেদন করেছেন। নতুন করে আর আবেদনের দরকার নেই।
বিএনপির কোনও কোনও নেতা মনে করেন, আবেদন করার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকার আচরণ পাল্টে ফেলে। নতুন করে আদালতের যাওয়ার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে।
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর ধারার ক্ষমতাবলে শর্তযুক্তভাবে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায়। এখন আইনের যে পরিস্থিতি, তাতে যদি কোনও পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে খালেদা জিয়াকে আগে যে শর্তযুক্ত মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, সেটিকে বাতিল করতে হবে। বাতিল করে স-অবস্থানে (আগের অবস্থায়) যাওয়ার পর আবার অন্য বিবেচনা করা যাবে। আইন অনুযায়ী, এখন যে অবস্থান, আইনের সেই অবস্থান থেকে সরকারের আর কিছু করার নেই।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কায়সার কামাল বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই করছেন। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য। ম্যাডামকে বিদেশে পাঠানোর জন্য নতুন করে আদালতে যাওয়ার সুযোগ নেই। বেগম জিয়াকে যে আইনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। সেক্ষেত্রে এখনও ম্যাডামের বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি নির্বাহী আদেশেই হতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে আইনজীবী কায়সার কামাল আরও উল্লেখ করেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর ধারায় সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, কোনও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে সরকার স্বীয় ইচ্ছায় অথবা বন্দির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শর্তশাপেক্ষ বা যেকোনও সময় মুক্তি দিতে পারে। শর্ত দিলে বন্দি সেই শর্ত গ্রহণ করলে, তা কার্যকর হবে। মূলত সরকারের পক্ষ থেকে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে।’
বিএনপির পক্ষ থেকে আদালতে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, এমন প্রশ্নে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার জানামতে, এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি জানি না। বলতে পারবো না।’
দলের চেয়ারপারসনের প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, বেগম জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগ সম্ভবত আর নেই।
সরকারের ইতিবাচক ইঙ্গিত পেলে সক্রিয় হবে পরিবার
বিএনপি, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও পরিবারের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও নেতা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশের ইঙ্গিত না পেলে পরিবার সক্রিয় হবে না। ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ ও আলোচনা চললেও বিষয়টিকে প্রকাশ্যে আনছে না কোনও পক্ষ।
এর আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তাকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলেন তার ভাই-বোনসহ পরিবারের সদস্যরা। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২০ সালের এপ্রিলে এ ঘটনাটিকে সামনে এনে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম, বোনের স্বামী রফিকুল ইসলাম দেখা করে মুক্তির আবেদন করেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, বেগম জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর চলতি মাসের মাঝামাঝি নিউ ইয়র্কে তিনি নিজেই ‘বেগম জিয়াকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন। সেদিক থেকে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে আবারও পরিবার তার কাছে যাবে কিনা, সে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত না। পরিস্থিতির কোনও উন্নতি না হলে সে সম্ভাবনাও আর নেই বলে জানান নেতারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবারও সাক্ষাৎ করবে কিনা বেগম জিয়ার পরিবার— এমন প্রশ্নে বুধবার রাতে বেগম জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার জানামতে পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগের বিষয়টি জানা নেই। আমি বলতে পারবো না।’
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল জানান, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরে নির্ভর করছে। এক্ষেত্রে বিষয়টি দুই নেত্রীর ওপর নির্ভর করছে বলেই জানান তারা।
দায়িত্বশীলদের ভাষ্য, আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পরিবার সাক্ষাৎ করবে কিনা, এর সম্ভাবনা নির্ভর করছে বেগম জিয়ার ওপরই। তিনি নিজে থেকে কাউকে দায়িত্ব দিলেই তবে বিষয়টি এগিয়ে যেতে পারে। তাদের দুজনের অবস্থান মুখোমুখি থাকবে কিনা বা দুই দলের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, তাও বেগম জিয়ার বিদেশযাত্রার ওপর নির্ভর করছে বলে দাবি করে সূত্র।
বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে কিনা, এমন প্রশ্নে বিএনপির প্রভাবশালী একজন নেতা বলেন, ‘‘বেগম জিয়ার ইস্যুটি অত্যন্ত মানবিক। এমন পরিস্থিতিতে তার পক্ষ থেকে বিশিষ্টজনদের কেউ উদ্যোগী হবেন কিনা, তাও সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ‘সাম্প্রতিক আচরণ’ এ ধরনের সম্ভাবনাকে নাচক করে দেয়।’’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বুধবার রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা দলীয় বিষয় না। সরকারের বিষয়। আইনকানুন প্রসিডিউর মেনে তাকে (খালেদা জিয়া) সাজা স্থগিত করে বাসায় থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের (বিদেশে পাঠানো) কোনও সুযোগ যদি থাকে, সেটা প্রসিডিউর মেনে সরকারের কাছে আবেদন করলে সরকার হয়তো দেখবে।’
বিএসডি/এমএম