নিজস্ব প্রতিবেদক
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের পর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৯৪ কোটি টাকা বকেয়া ও খেলাপি ঋণ আদায় করেছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি সহায়তার মাধ্যমে তারল্য সহায়তা পেয়ে ব্যাংকটি গতি ফিরে পেয়েছে। এখন গ্রাহকদের পুরো টাকা না দিতে পারলেও ছোট ছোট পরিমাণে তাৎক্ষণিক পরিশোধ করছে তারা। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে ব্যাংকটির ওপর গ্রাহকের পূর্ণ আস্থা ফিরে আসবে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম।
সোমবার (৭ অক্টোবর) সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি।
এ সময় ব্যাংকটির পরিচালক মাকসুদা বেগম, মো. মোরশেদ আলম খন্দকার ও মো. আনোয়ার হোসেনের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আবদুল হান্নান খান, বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান মো. নাজমুস সায়াদাতসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সাদিক ইসলাম জানান, ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রথম সারির ব্যাংকে পরিণত হয়েছি। কিন্তু সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক যখন সাফল্যের চূড়ার অভিমুখে এগিয়ে চলছিল দ্রুতগতিতে, ঠিক তখনই দুঃশাসন ও দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে প্রিয় এই ব্যাংক। ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ জোরপূর্বক দখল করে নেয় ব্যাংকটিকে। এস আলমের কবলে পড়ে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত আট বছরে ব্যাংকটির মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি যেমন দুর্বল হয়েছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকের গ্রাহক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই।
গত ২৫ আগস্ট এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন একজন উদ্যোক্তা শেয়ারধারীকে পরিচালক ও চারজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পর্ষদ পুনর্গঠনের পর পদত্যাগ করেন ব্যাংকটির এমডি জাফর আলম, ডিএমডি হাবিবুর রহমান ও খোরশেদ আলম। তাদের মধ্যে প্রথম দু’জন এস আলম গ্রুপের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর ব্যাংকটি থেকে নানা অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকটি আর্থিক সংকটে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় দুই বছর ধরে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকটিকে সহায়তা দিয়ে আসছিল। তবে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর সেই সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়ে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ যখন স্বৈরাচারী শাসনমুক্ত হয়ে পুনরায় স্বাধীনতার স্বাদ পেল, তখন দুর্বৃত্তের কালো থাবামুক্ত হলো আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত পড়ে যায় সাময়িক সংকটে। যেহেতু পতিত সরকারের সরাসরি দোসর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে দখল করে রেখেছিল, তাই এই ব্যাংকেরও ক্ষতি হয়েছে। সে কারণে এসআইবিএল বর্তমানে কিছুটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এর মধ্যে তারল্য সংকট অন্যতম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ৯০০ কোটি টাকা গ্যারান্টি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে ৪৫০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। আরও কয়েকটি ব্যাংক টাকা ধার দেওয়া ও আমানত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা আবারও ১৮টি সেবা প্রতিষ্ঠানের সেবা মাশুল নেওয়া শুরু করেছি। গ্রাহকরা শাখা থেকে ছোট পরিমাণে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন। রেমিট্যান্সের টাকা পেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সামনে এটিএম ও ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের সেবাও চালু হয়ে যাবে।
ব্যাংক থেকে কত টাকা বের করা হয়েছে, তা জানতে চাইলে এম সাদিকুল ইসলাম বলেন, এই ব্যাংক থেকে কে কত টাকা ঋণ নিয়েছে, তা চিহ্নিত করা গেছে। এস আলম গ্রুপ নামে ও বেনামে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। তাদের ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে আরও ৪৭১ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান চালু আছে, ফলে এসব টাকা আদায় করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, এস আলম গ্রুপ নামে ও বেনামে এসআইবিএল থেকে যে ঋণ নিয়েছে এর মধ্যে কিছু প্রকল্প চলমান আছে, যা থেকে টাকা আদায় সম্ভব এবং সেগুলো আদায়ের ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সোচ্চার আছি। এছাড়া, এই গ্রুপের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার এমটিডিআর (মেয়াদি আমানত) হিসাব ইতোমধ্যে স্থগিত রাখা হয়েছে।
এসআইবিএল চেয়ারম্যান বলেন, গত ৫ আগস্ট থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৯৪ কোটি টাকা ওভারডিউ ও ক্লাসিফাইড বিনিয়োগ থেকে রিকভারি করেছি। এই দুঃসময়েও আমাদের এই রিকভারির পরিমাণ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এলসি খোলাসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং কার্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের ওপর কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল, যা পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে চলেছে।