নিজস্ব প্রতিবেদক :
গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা আগের মতোই চলছে। ঢাকা মহানগরের প্রতিটি রুটেই পরিবহন শ্রমিকরা সর্বনিম্ন ভাড়া ১০-১৫ টাকা আদায় করছে। এছাড়া ন্যূনতম ভাড়া অধিক দূরত্বে বিভিন্ন রুট ভেদে ১০ থেকে ২০ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে নতুন ভাড়া নির্ধারণের পর থেকে গণপরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ও হাতাহাতি লেগেই আছে।
ভাড়া নৈরাজ্য নিয়ে প্রতিবাদ করলে পরিবহন শ্রমিকরা বাস চলাচল বন্ধ করে যাত্রীদের জিম্মি করছে। গতকাল সকালে ভাড়া নিয়ে বাকবিন্ডার এক পর্যায়ে মিরপুর ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড ও কালশি রুটের কয়েকটি বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। এরপর তারা ওই রুটে বাসচলাচল বন্ধ রাখে। ফলে এ রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। স থেকে বিকেল অবধি কালশি মোড়ে কয়েকশ’ যাত্রীকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
সূত্রমতে, রাজধানীতে কোনো সিটিং সার্ভিস থাকবে না, বাস চলবে না ওয়েবিলে। বাস মালিকরা এ সিদ্ধান্ত মানছে না। এনিয়ে পথে পথে যাত্রীদের সঙ্গে বাসচালক আর শ্রমিকদের বিরোধ বাধছে। মিরপুর-১২, মিরপুর-১০, মিরপুর-১ নম্বরসহ পুরো মিরপুর এলাকায় অধিকাংশ সিটিং সার্ভিস বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল বিকেলে মিরপুর এলাকায় বিভিন্ন রুটের বাস থেকে যাত্রীদের জোর করে নামিয়ে দেয় শ্রমিকরা। যাত্রীদের দাবী, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার থেকেও বেশি ভাড়া আদায় করছে শ্রমিকরা।
তবে শ্রমিকদের দাবি, যাত্রীরা সরকার নির্ধারিত ভাড়া দিলেও মালিকপক্ষ এখোনো ওয়েবিলের নির্ধারিত বাড়তি ভাড়া হিসাব করে দিন শেষে টাকা চায়।এতে করে সারাদিন গাড়ি চালিয়েও দিন শেষে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে বলে দাবি শ্রমিকদের।
ভুক্তভোগীরা জানান, দেড়-দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাস না পেয়ে অনেকে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন। কেউ কেউ সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা কিংবা রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেলে চড়ে কর্মস্থলে পৌঁছান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গণপরিবহন শ্রমিকরা শুধু নিজেদের বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি। তারা কিছু সময় পর অন্যান্য পরিববহন চলাচলেও বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানোয় তারা তাদের এ অপতৎপরতা বেশিক্ষণ চালাতে পারেননি।
পল্লবী থানার উপপরিদর্শক সজিব খান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ভাড়া নিয়ে তর্ক-বির্তক জের ধরে দুপুরে মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট-আব্দুল্লাহপুর ও নতুনবাজার রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সেখানে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করলেও পুলিশের উপস্থিতির কারণে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
এর আগে সকালে শনিরআখড়া ও কাজলাসহ আশপাশের এলাকাতে ভাড়া নিয়ে গণপরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও কিছু সময় পর তা আবার চলাচল শুরু করে। আকস্মিক বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই এলাকার যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েন।
গণপরিবহনের যাত্রীরা জানান, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সরকার নতুন করে বাস ভাড়া বাড়ানোর পর পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তারা যার যেমন ইচ্ছা তেমন ভাড়া আদায় করছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বললেও কার্যত তা অনেকটা কাগুজে নির্দেশনায় পরিণত হয়েছে।
নগরবাসীর অভিযোগ, পরিবহন মালিক সমিতি বিষয়টি দেখভালের কথা বলে কালক্ষেপণ করছে। পাশাপাশি অবৈধভাবে ভাড়া আদায়ের বিষয়টি কৌশলে ‘জায়েজ’ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।
যদিও পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা কোথাও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে না। প্রতিটি পরিবহনই সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নিচ্ছে। তবে পথের দূরত্ব নিয়ে কিছু জটিলতা রয়েছে। যাত্রীরা ১০ কিলোমিটার দূরত্ব ৬/৭ কিলোমিটার বলে দাবি করছে। এতে তাদের কাছে ভাড়া বেশি মনে হচ্ছে।
প্রতিটি স্টপেজের দূরত্ব নির্ধারণ করা থাকলেও সে অনুযায়ী ভাড়া না নেয়ার ব্যাপারে যাত্রীদের অভিযোগের কথা তুলে ধরা হলে গণপরিবহন মালিকরা জানান, টিকিট কাউন্টারগুলোও মিটার মেপে বসানো হয়নি। গুগল ম্যাপেও যে দূরত্ব দেখানো হয়েছে তা সঠিক নয়। তারা গাড়ির মাইলেজ মিটার দেখে ভাড়া নিচ্ছে। যেসব গাড়ির মিটার ঠিক নেই তারা আগের নির্ধারিত ভাড়া থেকে প্রতি কাউন্টারে গড়ে পাঁচ টাকা করে ভাড়া বেশি নিচ্ছে।
তবে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের দাবি, গণপরিবহনের টিকিট কাউন্টারগুলোর সঠিক দূরত্ব মেপেই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। তবে কোনো কোনো রুটে সব স্টপেজের দূরত্ব দেখানো হয়নি। ফলে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যখন গণপরিবহনের ভাড়া আকাশচুম্বী হয়ে যায় তখন এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বর্তমানে বিভিন্ন পথে যাত্রীদের সঙ্গে শ্রমিকদের হাতাহাতি ও বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়ার বিষয়গুলো এরই প্রভাবে ঘটছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ভাড়া নৈরাজ্যের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে। তবে এর আগে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরো জানায়, ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি চারটি প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো গণপরিবহন ভাড়া বাতিল করে ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য ভাড়া নির্ধারণ করা, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশে সব ধরনের যানবাহনের সামনে সেটি কোন ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করে তা উল্লেখ করে স্টিকার লাগানো, রাজধানীর বাসগুলোতে ওয়েবিল পদ্ধতি বাতিল করা, গণপরিবহনে টাকা তুলতে মালিকদের চাপানো দৈনিক টার্গেট বাতিল করা। এসব বিষয় বাস্তবায়ন করার বিষয়টি মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছে।
এছাড়া বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়ার সঙ্গে দেশব্যাপী লেগুনা, হিউম্যান হলার, নছিমন-করিমন, অটো-টেম্পো, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ সব ধরনের যানবাহনের ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন মনিটরিং করে ব্যবস্থা নেবে।
তবে গণপরিবহন খাত পর্যবেক্ষণকারীরা অনেকেই এ বিষয়গুলো সরকারের ভাঁওতাবাজি বলে মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পরিবহন খাতে সুশাসন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি। অথচ এ খাতটি গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে। সরকার ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন করলেও এই গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে তার বেশ কিছু ধারা কাটছাঁট করা হচ্ছে। এতে বছরের পর বছর যাত্রীদের স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।