সম্পূর্ণ নিজের মতো করে চলা একজন মানুষ ছিলেন নাদির শাহ। যা মনে আসত, বলে ফেলতেন। ঘোরপ্যাঁচ কী জিনিস জানতেন না। মানুষই ছিলেন যেহেতু, বিবেচনায় কখনো ভুল হয়ে থাকতেও পারে। তবু মনের ভাষা প্রকাশে ছিলেন অকপট।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে নাদির ভাই ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই রোগ তো ক্ষয় রোগ! ফিরে কি আসা যায়! তবু যখনই দেখা হয়েছে, বলতেন, ‘ফিলিং মাচ বেটার। সমস্যা নাই। দোয়া করো।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেই প্রিয় মুখ আইসিইউ, লাইফ সাপোর্টের পর্ব পেরিয়ে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত চারটার দিকে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। কিছুদিন ধরে তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকেই ছিল। ২ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর দ্রুতই চলে গেলেন অন্তিম সময়ের দিকে।
মাত্র ৫৭ বছর বয়সে নাদির শাহর প্রয়াণ বাংলাদেশের ক্রিকেটকে শোকস্তব্ধ করেছে। গতকাল বাদ জুমা ধানমন্ডির বায়তুল আমান মসজিদে তাঁকে শেষবিদায় জানাতে আসা দেশের ক্রিকেট সারথিদের চোখে-মুখে ভেসে থাকল সেই শোকেরই ছায়া।
সকালে দুঃসংবাদটা শোনার পর মেসেঞ্জারের ইনবক্সে তাঁর সঙ্গে পুরোনো কথোপকথনগুলো ঘাঁটছিলাম। কত কিছুর লিংক যে পাঠাতেন! ক্রিকেট, ফুটবল, রাজনীতি, লকডাউনে বাস চলছে কি না, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বাইডেনের কী হাল, মমতা কীভাবে মোদিকে পাল্টা দিলেন—সবকিছুতেই তুমুল আগ্রহ ছিল মানুষটার।
বিশেষ প্রীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জীবন আর পাকিস্তানের ক্রিকেটের প্রতি। নাদির শাহ হয়তো সুন্দর একটা গেঞ্জি পরে স্বভাবসুলভ কলার উঁচিয়ে মাঠে এসেছেন। দেখে কেউ প্রশংসা করে বললেন, গেঞ্জিটা তো সুন্দর! তাঁর জবাব হতো, ‘এটা কোথাকার জানো তো? মেইড ইন ইউএসএ।’ যেন দুনিয়ার সব ভালো জিনিস শুধু ওই এক দেশেই পাওয়া যায়!
সংসারটা টেকেনি, কিন্তু ক্রিকেটকেই করে নিয়েছিলেন জীবনসঙ্গী। নাদির ভাইয়ের ধ্যানজ্ঞানে খেলা ছাড়া অন্য কিছুর খোঁজ পাইনি কখনো। দুনিয়ার কোথায় কোন খেলা হচ্ছে, কোথায় কোন পেসার ১৪০ কিমির ওপরে গতি তুললেন, সব খবর রাখতেন। নাদির শাহর নিজস্ব জগতে যাঁদের আনাগোনা ছিল, তাঁরাও ছিলেন ক্রিকেটেরই মানুষ। বড় ভাই জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা তো একসময় জাতীয় দলেরই ডাকসাইটে খেলোয়াড় ছিলেন।
নাদির শাহও ঢাকার ক্রিকেটে আবাহনী, মোহামেডান, বিমান, সূর্যতরুণ, আজাদ বয়েজের মতো বড় ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। লেগ স্পিনার ছিলেন, ব্যাট করতেন মিডল অর্ডারে। খেলোয়াড়-আম্পায়ার স্টাম্পের দুই পাশের জীবনই তাই তাঁর চেনা ছিল।
২০০৬ সালে বগুড়ায় বাংলাদেশ-কেনিয়া ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাদির শাহর আম্পায়ারিং শুরু। মাঠে দাঁড়িয়ে আম্পায়ারিং করেছেন ৪০টি ওয়ানডে, ৩টি টি-টোয়েন্টি ও তিনটি মেয়েদের ওয়ানডেতে। ৬টি টেস্ট ও ২৩টি ওয়ানডেতে পালন করেছেন টিভি আম্পায়ারের দায়িত্ব। এ ছাড়া আম্পায়ার ছিলেন ৭৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ এবং ১২৭টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে।
অসুস্থতার কারণে মাঠ থেকে দূরে সরে আসার পর জীবনটা সীমিত হয়ে পড়েছিল ঘর, হাসপাতাল আর ফেসবুকেই। নিজের ফেসবুক পোস্টের শুরুতে নাদির ভাই লিখতেন, ‘সালাম মাই ডিয়ার কান্ট্রিম্যান…।’ যে কারও মঙ্গলকামনায় শেষে যোগ করতেন ‘জাযাকাল্লাহ খাইরান’ (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন)।
কাল যখন প্রাণহীন নাদির শাহকে শেষ গন্তব্যের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল চার চাকার শীতল প্রকোষ্ঠ, নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কথাটা, ‘গুডবাই মাই ডিয়ার কান্ট্রিম্যান নাদির শাহ। জাযাকাল্লাহ খাইরান।
বিএসডি/এএ