লাইফস্টাইল ডেস্ক,
একসাথে নীল জলরাশি, সবুজ পাহাড় আর সাদা মেঘমালার মিলনমেলায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন কক্সবাজারের ‘অচেনা দার্জিলিংয়ে’। মাতামুহুরি নদীর দুই পাশে উঁচু–নিচু পর্বতসারি, শীতের ঘন কুয়াশায় ঢাকা মেঘমালা। একটু দূরে গেলেই দেখা মেলে শ্বেতপাথরের বুক চিরে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঝরনার রক্তক্ষরণের। সাথে স্বচ্ছ-নীল জলের নদীতে ডিঙি নৌকায় ভাসতে ভাসতে আপনার মনে হবে এ যেন এক অন্য রকম দার্জিলিং।
কক্সবাজারের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন রূপ–লাবণ্যে ভরা এক লীলাভূমি এটি। জায়গাটিতে একবার যাদের পা পড়েছে, তাদের অনেকের মুখে দার্জিলিংয়ের তুলনা। বর্তমানে বিপুল পর্যটক টানছে অচেনা এই দার্জিলিং। সবমিলিয়ে এখন কক্সবাজারের পর্যটনের আরেক সম্ভাবনা ‘নিভৃতে নিসর্গ পার্ক’।
পার্কটির অবস্থান কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে, চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে কিছু দূর গেলে চোখে পড়বে পার্বত্য বান্দরবানের লামা উপজেলা। লামার মিরিনজা পর্যটনপল্লির উঁচু পাহাড়চূড়ায় আছে ইট-পাথরে নির্মিত বিশাল টাইটানিক জাহাজ। সেই জাহাজে দাঁড়িয়ে দেখা মেলে সুদূরের কক্সবাজার সৈকত, বঙ্গোপসাগর আর মহেশখালী চ্যানেলের।
সুন্দর বিলোচ্ছে মাতামুহুরি
প্রায় ১৪৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক আছে। নদীটি বান্দরবানের আলীকদমের আরাকান পর্বত থেকে উৎপত্তি হয়ে লামা হয়ে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ওপর দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। কারও মতে, লামার মাইভার পর্বতে মাতামুহুরির উৎপত্তি। মগ ভাষায় নদীর নাম ‘মা-মুরি’।
মতান্তরে, মাতৃস্তনসদৃশ বিভিন্ন পর্বত গাত্র থেকে জল চুইয়ে চুইয়ে পড়েই এ নদীর সৃষ্টি, এ কারণে নামকরণ মাতামুহুরি। মুহুরি শব্দের অর্থ অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে জল পড়ার ঝাঁঝর। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে আলীকদম, লামা, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা শহর। নীলনদ যেমন মিসরের জন্য দান, তেমনি মাতামুহুরী বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার চারটি উপজেলার অন্তত সাত লাখ মানুষের ভাগ্যবদলের আধার। নদীর তীরে শীতকালীন শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদনের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে মৎস্য ও পোলট্রি খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও পর্যটনকেন্দ্র। নদীটির গড় প্রস্থ ১৫৪ মিটার। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের কারণে নদীর পানি ফুলে ওঠে, তখন প্রস্থ আরও বেড়ে যায়।
৮৮৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কক্সবাজার জেলার লোকসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। উত্তরে পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের সীমানা থেকে দক্ষিণ দিকের টেকনাফের বদরমোকাম পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪৫ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূল। জেলার ৫০ ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে ছোট–বড় অসংখ্য পাহাড় পর্বত। শুধু কুতুবদিয়া উপজেলাতে পাহাড় নেই। হিমালয়ের পর্বতমালার দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারিত আরাকান পর্বতমালা জেলার পূর্বভাগের ওপর দিয়ে গেছে। এ কারণে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, চকরিয়াতে পাহাড় ও বনাঞ্চল বেশি। জেলার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ‘তুনাঙ্গানাঙ্গা’—সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৮০ ফুট। এটির অবস্থান টেকনাফের জাহাজপুরা এলাকায়। দ্বিতীয় উচ্চতার ৫৫১ ফুটের পর্বত নেটংও টেকনাফে। তৃতীয় উচ্চতার ‘নাগাটং’ ৫৪৫ ফুট—চকরিয়ায়। পাহাড়ের কারণে জেলায় অসংখ্য ছোট–বড় নদীর সৃষ্টি। এর মধ্যে বড় তিনটি নদী মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও রেজুর উৎপত্তি পাহাড় থেকেই। মাতামুহুরী নদীর মধ্যভাগেই গড়ে ওঠে অচেনা দার্জিলিং।
পাহাড়-ঝরনার ইয়াংছা
সবুজ পাহাড়, নীল জলের ঝরনায় দৃষ্টিনন্দন জায়গাটি এত দিন পর্যটকের দৃষ্টিসীমার বাইরে ছিল। নজরে আসেনি গণমাধ্যমেরও। অচেনা এই পর্যটন স্পটের নামকরণ ‘নিভৃতে নিসর্গ পার্ক’ হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। সম্প্রতি কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের একটি দল পরিদর্শন করেন অন্য রকম দার্জিলিং। এর রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হন সবাই। পার্কের নামকরণ ‘নিভৃতে নিসর্গ পার্ক’ জেলা প্রশাসকের দেওয়া। ওই দিন সেখানে পার্কের ফলকও উন্মোচন করা হয়।
এরই মধ্যে পর্যটকরা ডিঙি নিয়ে নদী ভ্রমণ করছেন। বেশির ভাগ স্থানীয়, অল্প কিছু পর্যটক। তারা ইয়াংছারমুখ ঘাট থেকে নৌকায় উঠে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে লামাবাজার যাচ্ছেন। এরপর পর্বতের রানী লামা উপজেলা ঘুরে নৌকায় পুনরায় ইয়াংছার মুখ ঘাটে ফিরে আসছেন তারা। মানিকপুর ঘাট দিয়েও অনেকে নদীভ্রমণে যাচ্ছেন। চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় পুরো পার্কটির তত্ত্বাবধান করছে স্থানীয় সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ। ইউপি চৌকিদার সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে চারজন স্বেচ্ছাসেবী পার্কটি দেখাশোনা করছেন। পার্কে প্রবেশে টাকা দিতে হয় না।
পার্কের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে হাজারো মানুষ লামাবাজার আসা–যাওয়া করছেন। এর মধ্যে অন্তত ৩০০ জন পর্যটক। সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নদীভ্রমণ সবার জন্য উন্মুক্ত।
সিলেট থেকে স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে ভ্রমণে আসা এক পর্যটক বলেন, কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে গিয়ে জানতে পারি নতুন এই পর্যটনকেন্দ্রের কথা। তারপর দেখতে আসা। নদী ভ্রমণ করে আনন্দ পেয়েছি। তবে বিনোদনের আরও সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি দরকার। পুরো পার্কে বিদ্যুৎ নেই।
পার্কের পাশের একটি পাথরের পাহাড়ের নামকরণ করা হয় ‘শ্বেত পাহাড়’। এর আশপাশে একসঙ্গে দেখা যায় পাহাড়, পাথুরে নদী, ঝরনা, মেঘ-কুয়াশা, বন্য প্রাণী, স্বচ্ছ নীল জলরাশি ইত্যাদি।
স্থানীয় এক ইউপি সদস্য জানান, ২৬ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন পার্কটির উদ্বোধন করেন। মূলত এরপর থেকে পর্যটকেরা ‘নিভৃত নিসর্গ’ দেখতে ছুটে আসছেন। ক্রমে পর্যটকের আগমন বাড়ছে। গত মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) ২২টি নৌকা নিয়ে নদী ভ্রমণে নেমেছেন দুই শতাধিক পর্যটক। আগের দিন ২৮টি নৌকায় নেমেছেন প্রায় ৩০০ জন। প্রায় ৬৪ কোটি টাকায় নির্মাণাধীন (ইয়াংছাঘাট পর্যন্ত) ১৯ কিলোমিটারের ‘জিন্দাবাজার-ইয়াংছাঘাট সড়কটি’ পাকা হয়ে গেলে যোগাযোগ সহজ হবে। নিভৃত নিসর্গ পার্কে বিদ্যুৎ–সংযোগের কাজও চলছে দ্রুতগতিতে।
পার্কের তথ্য সরবরাহকারী কর্মকর্তা ও চকরিয়া উপজেলা ডিজিটাল সেন্টারের পরিচালক এরশাদুল হক জানান, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনি—দুই দিন পার্ক ভ্রমণে যাচ্ছেন দৈনিক অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ। অন্য দিন যাচ্ছেন এক থেকে দুই হাজার জন। পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য সেখানে আছে ৬০টির অধিক ছোট–বড় ডিঙি নৌকা। শীতকালে নদীর পানি শুকিয়ে গেছে, তাই লামাবাজার পর্যন্ত যাতায়াত চলছে। বর্ষাকালে পানি বেড়ে গেলে নৌকায় আলীকদম পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হবে। এখন লামা যেতে নৌকাভাড়া (রিজার্ভ) লাগে ১ হাজার ২০০ টাকা। প্রতিটি নৌকায় ওঠেন ১৫-২০ জন।
পর্যটনের নতুন দিগন্ত
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত দেখতে সম্প্রতি কয়েক লাখ মানুষ কক্সবাজার ছুটে এসেছেন। তারা সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, মহেশখালী, রামুর দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করে ঘরে ফিরছেন। কিন্তু অচেনা দার্জিলিং একবার গেলে বারবার দেখতে যাওয়ার মতো একটি জায়গা। পর্যটকসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ যেন সহজে ‘নিভৃত নিসর্গ’ ভ্রমণে যেতে পারেন, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে জেলা প্রশাসন। বিশেষ করে লোকজনের সহজ যাতায়াত এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পার্কটিকে আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হবে। পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এই পার্ক।
যেভাবে যেতে হয়
কক্সবাজার অথবা ঢাকা থেকে সড়কপথে (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক) প্রথমে চকরিয়া পৌরসভা বাসস্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে জিপ অথবা মিনিবাসে উঠে প্রায় আট কিলোমিটার গেলে ফাঁসিয়াখালী স্টেশন। সেখান থেকে যেতে হবে বান্দরবানের লামা সড়ক ধরে ১২ কিলোমিটার দূরে ইয়াংছাবাজারে। ইয়াংছাবাজার থেকে অটোরিকশা অথবা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) নিয়ে আড়াই কিলোমিটার গেলেই (এখন ইট ও কাঁচা রাস্তা) সামনে পড়বে কাঙ্ক্ষিত সেই পর্যটন স্পট ‘নিভৃতে নিসর্গ’। চকরিয়া থেকে নিভৃত নিসর্গ পার্কে যেতে ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। প্রাইভেট কারেও যাতায়াত করা যায়। কক্সবাজার শহর থেকে সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসা যায়। ইচ্ছা করলে ফিরতি পথে চকরিয়া বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, রামু বৌদ্ধপল্লি, রাবার বাগান, কক্সবাজার শহরের রাখাইন তরুণীদের বার্মিজ মার্কেট ঘুরে আসা যায়।
বিএসডি/আইপি