পর্যটন ডেস্ক,
ঘোরার রোগ, অনেকটা গরীবের ঘোড়ার রোগের মত। রোগ হলেও এটি সামাজিকভাবে স্বীকৃত। তাই লম্বা ছুটিতে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ঈদুল আযহায় একদিনের ছুটিতে নয়দিন।
আর মেঘের রাজ্য সাজেক বর্ষায় সাজে অপার্থিব সৌন্দর্য্যে। যোগাযোগেও অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়ায়। ভ্রমণ প্রিয়সিদের কাছে এখন প্রিয় গন্তব্যের নাম সাজেক।
সাজেক ভ্যালি যেকোন সময় যাওয়া যায়। তবে বর্ষার স্নিগ্ধতায় পাহাড়ের রুপে আসে লাবণ্যতা। আর ক্ষনে ক্ষনে রুপ বদলানো বিবির মুডের মত সাজেকের রোমান্টিক আবহাওয়ায় আপনি হবেন বিমোহিত। এছাড়াও আকাশ এখানে দিগন্তের নীল ছুঁয়ে পাহাড়ে হেলান দিয়ে ঘুমায়।
মেঘ উড়না উড়িয়ে দিগঙ্গনার নৃত্য করে। এর অবস্থান রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় হলেও যোগাযোগ সহজ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হয়ে।
খাগড়াছড়ি যখন পৌঁছাই তখন সকাল ৭.৩০টা। জিপ (চান্দের) গাড়ির দফারফা করতে গিয়ে দেখি পর্যটকদের মিলন মেলা।
সকাল দশটা ত্রিশ মিনিটে রুট ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর সারি সারি গাড়ি ছুটতে থাকলো বাঘাইহাট নিরাপত্তা চেকপোষ্ট থেকে। দেখা হলো কাসালং, মাসালং, মাইনি সহ উপত্যকার ভাঁজে ছোট ছোট অনেক নদীর। তাদের একটি সাজেক। সাজেক নদীর নাম থেকে সাজেক ইউনিয়নের নাম।
বাঘাইহাট থেকে সাজেকের পথটি বেশ রোমাঞ্চকর। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথে সারি সারি জিপ গাড়ি ছুটে চলার দৃশ্য এবং বাতাসে দোল খাওয়া গুল্মলতায় মনকেও দুলিয়ে তুললো।
মনে হলো আদিবাসী শিশুদের মত হাত নাড়িয়ে গুল্মলতাও অভিবাদন জানাচ্ছে। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে রোলার কোষ্টারের অনুভূতি ছিল বেশ উপভোগ্য। টাইগার টিলা আর্মি চেকপোষ্ট ও মাচালং বাজারে বিরতি দিয়ে বেলা দেড়টায় আমরা পৌছে গেলাম সাজেক।
হোটেলে চেকইন করে দুপুরের খাবারের অর্ডার করি। খাবারের দাম ও তালিকা সব দোকানে সমান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলায় সাজেকের সবোর্চ্চ চূড়া কংলাকে।
ছোট ফুটপাতের পরিচ্ছন্ন সাজেকের প্রথমে রুইলুইপাড়া। যেখানে হোটেল ও রিসোর্টগুলো আর শেষ মাথায় কংলাক পাহাড়ের চুড়ায় কংলাকপাড়া। দুই পাড়ার মধ্যে ৩০-৪০ মিনিট হাটার দুরত্বের কিছুটা পাকা ও কিছুটা মেঠপথ।
এখানে লুসাই, পাংকুয়া ও ত্রিপুরাদের বসবাস। প্রকৃতির মত সুন্দর পাহাড়ের সহজ সরল আদিবাসী মানুষের সংগ্রামী জীবন থেকে হয়তো অনেক কিছু শেখার আছে। কংলাক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। সাজেকের পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও উত্তরে ত্রিপুরা রাজ্য।
পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা এবং দক্ষিনে রাঙ্গামাটির লংগদু। এদের শিক্ষা, সামাজিক বন্ধন ও জীবন প্রবাহ প্রতিবেশী দেশের মিজোরামের সঙ্গে। কংলাকের চুড়ায় না উঠলে সাজেক ভ্যালি ভ্রমণ বৃথা। এখান থেকে সবুজ পাহাড় ও মেঘের সমুদ্র দেখে মনে হলো দার্জিলিং এসেছি।
কংলাক পাহাড় থেকে নামতে নামতে চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। এসে দেখি, রুইলুই পাড়ার রাতের সাজেক সেজেছে মায়াবী এক অপ্সরায়। আপনার কাছে মনে হতে পারে দেশের ভেতর অন্য কোনো এক দেশ। বাম্বু চিকেন, বারবিকিউ, ক্যাম্প ফায়ার, ফানুস উড়িয়ে উপভোগ করতে পারেন ভ্রমণ আনন্দকে।
পর্যটকরা সাজেক বলতে রুইলুই ও কংলাক পাড়াকেই বুঝে থাকে। কিন্তু এছাড়াও আরও অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। সাজেক উপত্যকার এসব অদেখা গ্রাম ছবির মতো সুন্দর। নিরাপত্তা ও যোগাযোগে পিছিয়ে পড়ার কারণে মানুষের দৃষ্টি সীমার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
ভোরে বারান্দায় মেঘের লুকোচুরি। সঙ্গে প্রিয় ঋতু বর্ষার ঝুম বৃষ্টি। ফিরে পেয়েছি শৈশবের চুরি হওয়া রিমঝিম বৃষ্টির, টিনের চালের ঝুমঝুম শব্দ।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায়, সূর্য্যের দেখা মিলছে না। বারান্দায় মেঘ, বৃষ্টি বিলাসে কেটেছে সময়। আকাশ পরিস্কার হতেই আমরা ছুটলাম হেলিপ্যাডের দিকে। ততক্ষনে সূর্য্যের আলোয় আলোকিত সাজেকের আকাশ।
পাহাড়ের ভাঁজে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। সঙ্গে ঝলমলে রোধ। চারিদিকের সব কিছু ক্রিষ্টাল ঝকঝকে। হেলিপ্যাড থেকে আসার পথে নাস্তা করে ন’টার মধ্যে হোটেলে চেক আউট করে সেনাবাহিনীর স্কট ধরে যখন খাগড়াছড়ি পৌছাই তখন ঘড়ির কাটায় দুপুর ১.৩০টা।
খাগড়াছড়িতেই দুপুরের খাবার শেরে উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়, নামহীন বুনোফুলের নয়নাভিরাম অফুরন্ত সৌন্দর্যে পাহাড়ের ঢালু গড়িয়ে কল্পনার রাজ্য রিছাং ঝর্ণা। সেখান থেকে আরবারি পাহাড় বা আলুটিলা।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৭ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত আলুটিলা গুহা বা রহস্যময় সুড়ঙ্গ। স্থানীয়রা একে বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। অন্ধকার গুহার ভিতরটা ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। ঝুলন্ত সেতু দেখে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা।
এবার বাস কাউন্টারে যাদুর শহরে ফেরার প্রহর গুনছি, আর ভাবছি – জীবনের কঠিন অংকগুলো খুব সহজে মিলবে কিনা জানি না। তবে আত্মবিশ্বাস এবং কিছু মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরছি মেঘের রাজ্য থেকে। কারণ রয় এম. গুডম্যান বলেছিলেন – মনে রাখবেন সুখ ভ্রমণের একটি উপায়, একটি গন্তব্য নয়।
বিএসডি/এমএম